সম্প্রতি প্রস্তাবিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনীর খসড়ায় তামাক কোম্পানিগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) কার্যক্রম নিষিদ্ধের প্রস্তাব করা হয়েছে। যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে, তামাক-সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো সিএসআর তাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়ীক স্বার্থে ব্যবহার করে। তবে, খাত সংশ্লিষ্টরা প্রশ্ন তুলছেন, আইনের সংশোধনীর প্রধান লক্ষ্য যেখানে তামাকের ব্যবহার হ্রাস করা, ধূমপান হ্রাস করা, সেখানে সিএসআর বন্ধ হলে তা কীভাবে তামাকের ব্যবহার হ্রাসে ভূমিকা রাখবে তা বোধগম্য নয়। বরং লাখো প্রান্তিক অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জীবনধারণে, ভালো থাকার চেষ্টায় সিএসআর কার্যক্রম অবদান রেখে চলেছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যমান আইনে স্পষ্ট করা আছে, কোনো ধরনের সিএসআর কার্যক্রমের সময় তামাক কোম্পানিগুলো নিজেদের নাম ব্যবহার করতে পারবে না। ফলে, তামাকজাত পণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার না করে চলা সিএসআর কার্যক্রম নিষিদ্ধের উদ্যোগের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন আসা অবান্তর নয়। কারণ, সিএসআর কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলে ধূমপান বা তামাকের ব্যবহার হ্রাস পাবে এমন দাবির পক্ষে কেউ কোনে যুক্তি হাজির করতে পারেনি। বরং সিএসআর কার্যক্রম বন্ধ হলে লাখো মানুষের জীবনমান উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। একপক্ষের দাবি হচ্ছে, বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের কিছু দুর্বলতা যেমন তামাক-সংশ্লিষ্ট কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচি (সিএসআর) নিষিদ্ধ না থাকায় তামাক ব্যবহার হ্রাসে তা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না। ব্যবসা অব্যাহত রাখতে তামাক কোম্পানিগুলো সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচি (সিএসআর) কার্যক্রম ব্যবহার করছে। তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. আব্দুল ওয়াদুদের মতে, বর্তমানে অর্থনৈতিক মন্দাবস্থায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ. সিএসআর কার্যক্রমের সরাসরি সুবিধাভোগী হয় জনগণ। এর মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়।
অধ্যাপক ওয়াদুদের মতে, তামাক-সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর সিএসআর কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্ত হবে ভুল। বর্তমান পরিস্থিতিতে যেকোনো প্রতিষ্ঠানের সিএসআর বন্ধ করাই হবে ভুল সিদ্ধান্ত। ধূমপান জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হওয়ার পরও সরকার এখনো তা বেআইনি ঘোষণা করেনি। এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘তামাক কোম্পানির সিএসআর কার্যক্রম নিষিদ্ধের পরিবর্তে আমাদের বরং ধূমপান হ্রাসের জন্য সচেতনতা কার্যক্রম বাড়ানো দরকার। তিনি বলেন, তামাক কোম্পানির সিএসআর কার্যক্রম অনেক নতুন কর্মসংস্থার সৃষ্টি করছে। এসব কার্যক্রমের ফলে সরকারও প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বড় ধরনের রাজস্ব পাচ্ছে। হুট করে তা বন্ধ করা দেশের জন্য মঙ্গলকর হবে না। বিশেষ করে, যখন তামাক কোম্পানিগুলো আইনিভাবে কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ পাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিশেষ করে বড় প্রতিষ্ঠানের সিএসআর কার্যক্রম জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়ক হবে বাংলাদেশের জন্য। কারণ গত কয়েক দশক ধরে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর সিএসআর কার্যক্রম দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ব্যাপক অবদান রাখছে। এসব কার্যক্রম বন্ধ করা হলে একটি প্রতিষ্ঠিত সফল কাঠামো ভেঙে পড়বে এবং লাখো মানুষ এর সুফল বঞ্চিত হবে। আর তামাক কোম্পানিগুলোর সিএসআর বন্ধ হলে দেশে ধূমপান বা তামাকের ব্যবহার কমে যাবে এমন দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণও নেই। বিশেজ্ঞরা বলেন, টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করায় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি অংশীদারিত্ব প্রয়োজন। তামাক-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের প্রতিষ্ঠানের প্রচারণা ব্র্যান্ডিং ছাড়া দেশের আইন মেনে কয়েকটি দীর্ঘমেয়াদী কমিউনিটি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম বন্ধ করার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশেষ করে যখন এসব কার্যক্রমের বেশ কয়েকটি জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে সক্রিয় অবদান রাখছে, তখন তা বন্ধ করা বরং উল্টো ফল দিবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশে বৃক্ষরোপণে বড় ভূমিকা রাখছে সিএসআর কার্যক্রম। বেসরকারি খাতের সিএসআর কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে সারা দেশে ১২ কোটি চারা বিতরণ করা হয়েছে।টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের ২৫ শতাংশ ভূমি বৃক্ষ আচ্ছাদিত করবার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এই কার্যক্রমে সহায়ক হচ্ছে বেসরকারি খাতের সিএসআর কার্যক্রম।
আর্সেনিক ও লবণাক্ততার ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য নিরাপদ সুপেয় পানির ব্যবস্থাপনায় ভূমিকা রাখছে সিএসআর। দেশে বন্যার ধাক্কা ক্রমশ বাড়ছে। হাসপাতালগুলোকে সক্ষমতার তুলনায় বেশি রোগীকে চিকিৎসা সেবা দিতে হচ্ছে। রোগীদের অনেকে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত। নিরাপদ সুপেয় পানির ব্যবস্থাপনা এই ধাক্কা অনেকটা প্রশমন করছে। সিএসআরের অংশ হিসেবে প্রায় ৩ লক্ষ্য সাধারণ মানুষের জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহ করছে তামাক কোম্পানি পরিচালিত কার্যক্রমগুলো। সিএসআর কার্যক্রম বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর সামজিক দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে সহায়তা করে। এমন বাস্তবতায় তা বন্ধ করে লাখো মানুষের জীবনমান উন্নয়নের উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত করা হবে কেন, বিশেষ করে যখন তা ধূমপান হ্রাসে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না।