বাংলা ভাষায় প্রতিনিয়ত ঢুকছে বিদেশি শব্দ। তাতে করে অনেক প্রচলিত শব্দ হারাতে বসেছে। মানুষের মুখে মুখে যেমন, তেমনি সরকারিভাবেও প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বিদেশি শব্দ আত্তীকরণ করা হয়েছে। দুইদশকে বাংলায় সরকারিভাবে দুই হাজার ৫০০ নতুন শব্দ ঢোকানো হয়েছে। যার পুরোটাই বিদেশি। এরমধ্যে আঞ্চলিক বা উপভাষা থেকে একটি শব্দও আনা হয়নি।

ভাষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপ্রয়োজনীয় শব্দ আত্তিকরণ না করা ভাল। শেখা উচিত নিজস্ব পরিভাষা তৈরির। তাহলে ভাষা সমৃদ্ধ হয়। বিদেশি শব্দ নিতে হবে কিন্তু তা হড়ে গড়ে নয়। বেছে বেছে। যা আমাদের মনের কথা সহজে প্রকাশ করতে সহায়তা করবে, তা নিতে হবে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ (বাবাকো) প্রশাসনিক পরিভাষা তৈরি করে। দুইদশক পরে বাবাকো নতুন করে প্রশাসনিক পরিভাষা প্রকাশ করেছে কয়েকবছর আগে। তার আগে ১৯৯৪ সালে প্রশাসনিক পরিভাষা প্রকাশ করেছিল। বইটির প্রকাশনা বিষয়ক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘অনেক নতুন শব্দ নতুন কলেবরে প্রশাসনিক পরিভাষায় অর্ন্তভুক্তির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেওয়ায় প্রায় ২৫০০ নতুন শব্দ অর্ন্তভুক্ত করে বাংলাভাষা বাস্তবায়ন কোষ, প্রশাসনিক পরিভাষা পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশ করেছে।’ বইটির ভূমিকায় বলা হয়েছে, ‘পরিভাষা কমিটি প্রতিটি শব্দের ব্যুৎপত্তি, মূল অর্থ, ব্যবহৃত অর্থ ইত্যাদি খুঁটিনাটি বিচারপূর্বক সিদ্ধান্ত  গ্রহণ করেছে।’

অথচ বাবাকো’র নতুন প্রশাসনিক পরিভাষা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে বিদেশি শব্দগুলো পরিভাষায় আনা হয়েছে তার অনেক শব্দের খুব ভাল বাংলা আছে। শুধু ভাল বাংলা আছে তাইই নয়, সেগুলো বহুল প্রচলিতও। শুধু অভিধানে নয় মানুষের মুখে মুখেও সে সব শব্দ আছে। তবু সে সব শব্দ বাদ দিয়ে সরাসরি ইংরেজি শব্দকে বাংলায় স্থান দেয়া হয়েছে। যেমন ‘স্টক এক্সেচেঞ্জ’। আবার এর বিকল্প হিসেবে রাখা হয়েছে ‘শেয়ারবাজার’। বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে এটি করা হয়েছে। প্রচলিত ‘পুঁজিবাজার’ শব্দটি রাখাই হয়নি। প্রশাসনিক পরিভাষায় ‘স্টক এক্সেচেঞ্জ’ এর অর্থ ‘স্টক এক্সেচেঞ্জ’ করার ফলে এই শব্দটিই এখন থেকে বাংলা হলো। এমন আরও অনেক শব্দ আছে যা পরিভাষায় সরাসরি ইংরেজি শব্দটিই বাংলা হিসেবে অনুবাদ করা হয়েছে।

যেমন মেডিকেল অফিসার, গেজেটেড অফিসার, পাসওয়ার্ড, কিটবক্স, সিকিউরিটি, সিভিল সার্ভিস, প্রেসক্লিপিং ইত্যাদি। এগুলোর কোন বাংলা অনুবাদ না করে সরাসরি ইংরেজি বাংলা করা হয়েছে। কিন্তু এসবের প্রত্যেকটির প্রচলিত বাংলা আছে। যেমন মেডিকেল অফিসার> চিকিৎসা কর্মকর্তা, গেজেটেড অফিসার> প্রথমশ্রেণির কর্মকর্তা, পাসওয়ার্ড>গোপন সংকেত, সিভিল সার্ভিস>জনপ্রশাসন, সিকিউরিটি>নিরাপত্তা, স্টেডিয়াম>মাঠ, স্টাইপেন্ড>বৃত্তি ইত্যাদি।

ভাষা বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমাদের চেষ্টা করা উচিত পরিভাষা তৈরি করা। বৈজ্ঞানিক কিছু বিষয় যদি হয় তবে সেগুলো ভিন্ন বিষয়। বৈজ্ঞানিক অনেক শব্দ আছে যা হইতো বাংলা করা সম্ভব নয়। সেটা সরাসরি নিতে পারি। কিন্তু যে শব্দগুলো তৈরি করা সম্ভব তা সরাসরি না নিয়ে তৈরি করা উচিত। আর এটিই ঠিক পথ। আঞ্চলিক থেকেও মূল ধারায় শব্দ আনা যেতে পারে। প্রচলিত শব্দ থাকলে সেটিই প্রথম নেওয়া উচিত।

নতুন কলেবরে বের করা পরিভাষায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইংরেজি ও বাংলা দুটো শব্দই পাশাপশি রাখা হয়েছে। যে যেটা ইচ্ছে ব্যবহার করবে। যেমন ‘একটিং প্রেসিডেন্ট’ এর দুটো বাংলা করা হয়েছে। ‘অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট’ ও ‘অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি’। তারমানে ‘প্রেসিডেন্ট’ শব্দ এখন বাংলা? এ ধরনের আরও শব্দ আছে। যেমন মর্গ>শবাগার, বাসা>কোয়ার্টার, প্রতিবেদক>রিপোর্টার, সিদ্ধান্ত>রুলিং, সাইরেন>সংকেত বাঁশি, স্টক>মজুদ, এক্স-রে রিপোর্ট>রঞ্জনরশ্নি প্রতিবেদন, উড়োজাহাজ>বিমান, ব্যাংক জামানত>ব্যাংক গ্যারান্টি, অঙ্গন>ক্যাম্পাস, ক্যাপশন>পরিচয়জ্ঞাপক বিবরণ, সার্টিফিকেট>সনদ, ডেসপাচ>প্রেরণ করা বা পাঠানো বা ছেড়ে দেয়া, ডাউনপেমেন্ট>ক্রয়মূল্যের প্রাথমিক পরিশোধযোগ্য অংশ। এন্ট্রি ফি>প্রবেশ মূল্য, ইরেজার>মুছে ফেলা, নিশ্চিহ্ন করা, দ্রত টেলিগ্রাম>তারবার্তা, হাইজ্যাক>ছিনতাই, হট লাইন>সরাসরি লাইন, হাইব্রিড>শংকর, জেলখানা>কারাগার, এজমালী>যৌথ ভূ সম্পত্তি  জয়েন্ট ইস্টেট, জার্নাল>পত্রিকা ইত্যাদি।

কিছু ইংরেজি বাংলা মিলিয়ে শব্দ করা হয়েছে। যেমন, ব্যাংকের পাস বই, বাণিজ্যিক এজেন্ট, কাউন্টার বিলি, তলবী ড্রাফট, জরুরী ওয়ার্ড ইত্যাদি।

যেসব বিদেশি শব্দ প্রশাসনিক পরিভাষায় সরাসরি ঢুকিয়ে বাংলায় আত্তিকরণ করা হয়েছে, অর্থাৎ যার কোন বাংলা অনুবাদ না করে বিদেশি শব্দটিই রাখা হয়েছে তাহলো এডহক, অ্যাডমিরাল, এজেন্সি, ব্যাংক ড্রাফট, ব্যাংক নোট, ব্যানার, বার কাউন্সিল, ব্যারিস্টার, ব্যাটেলিয়ান, ব্যাটারি, ব্যাটারি চার্জ, বিল, ব্রিফকেস, ব্রডব্যান্ড, ব্রডগেজ, বাজেট, ক্যাডেট, ক্যাডার, ক্যাডার সার্ভিস, ক্যাম্প, ক্যাপ্টেন, কপি, ক্যাশ বই, ক্যাম্প, সিনিয়র ক্যাম্প রেজিস্টার, ক্যাসেট, চার্টার অ্যাকাউন্টান্ট, চেক/ব্যাংক চেক, সিভিল, সিভিল সার্ভিস, সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট, ক্লিনিক,  কোচিং সেন্টার, কমিশন এজেন্ট, কমনওয়েল্থ, কম্পাউন্ডার, কম্পিউটার, কনফারেন্স, কনস্টেবল, কনসাল, কনসাল অফিস, কন্টেইনার সার্ভিস, কর্পোরেশন, কালভার্ট, ডিজিটাল,  ডিপ্লোমা, ডিভিশন বেঞ্চ, ই-মেইল, এস্টাবিসমেন্ট, ম্যানুয়াল, ইস্টেট, এক্সচেঞ্জ ফি,  ফেলোসিপ ফাউন্ডেশন, গ্যালারি, গ্যারেজ ব্রড গেজ, মিটার গেজ, গেজেট, গেজেটেড অফিসার, গার্ল গাইড, গ্রেড, গার্ড ফাইল, গ্রিল্ড হার্ডডিস্ক ইনবক্স, ইনস্টিটিউট, ইন্টারনেট, কিটবক্স, লেবেল, ল্যাপটপ, লে-অফ, লে-আউট, লীকসেট, লেভেল ক্রসিং, লাইসেন্স, লাইফ ভেস্টা, লাইন, লকআউট, মেসার্স, মেইলবক্স, মেইন ট্রেন, ম্যানহোল, মাস্টার রোল, মিটার, মিটার গেজ, মিল,  মিসড কল, মিশন, মিকচার, মোবাইল ফোন, মডেম, মানিঅর্ডার, মনিটর, মনোগ্রাম, মাদারবোর্ড, মাউস, নোটারি পাবলিক, নোট সীট, নোটিশ,  অফিসিয়েলিং আউটবক্স, ওভারড্রাফট, প্যাকেট, প্যানেল, পার্শেল, পাসওয়ার্ড, পে-অর্ডার, পে-রোল, পারমিট, পেট্রোল, ফোন, ফটো, ফটোপ্রিন্ট, ফটোকপি, পিকেটিং প্লাকার্ড, প্লাস্ট, প্লাটফর্ম, প্লাটুন, পোর্টফোলিও, পোস্টাল অর্ডার পাওয়ার অব এর্টনি, প্রেসক্লিপিং, পেসকাটিং, প্রাইজবন্ড, প্রমিসরি নোট, প্রটোকল, রাডার, লটারী, রেস পুলিশ, র‌্যালি, রেকর্ড, রেফারী, রিমান্ড, রোটারী ক্লাব, রয়্যালটি, রবার স্ট্যাম্প, রানওয়ে, সেলুন, স্কেল, স্কল, সার্চ লাইট, সীট-বেল্ট, সেক্টর, সিনেট, সেপটিক ট্যাংক সার্ভিস, সার্ভিস চার্জ, সেটেলমেন্ট, শেয়ার সার্টিফিকেট, শেয়ার হোল্ডার, শরিয়াহ, শুটিং, সর্ট সার্কিট, শো-রুম, সাটল ট্রেন, প্যাড, গেইট, সলিসিটর, স্পিড বোট, স্পাইরাল বাইন্ডিং, স্পন্সর, স্টেডিয়াম, স্ট্যাম্প, স্টেশন, স্ট্রং-রুম, সাব-পোস্ট অফিস, সাব-এজেন্সি, সার্কিং, সিস্পোজিয়াম, সিন্ডিকেট, সিনথেটিক, ট্যাগ, ট্যানারি, টেলিগ্রাম মনিঅর্ডার, টেলিফোন. টেলিপ্রিন্টার. টেলেক্স, টেরেস্ট্রিয়ান, টেস্ট, টেস্ট রিলিফ, টাইমস্কেল, টিস্যু পেপার, টয়েলেট, ট্রেড-ইউনিয়ন. ট্রফি ট্রান্সফর্মার, ট্রলার, ট্রেজারি বিল, ট্রাইব্যুনাল, ট্রাংক কল, ট্রাস্ট, টাইওভার, টাইফয়েড, ইউনিয়ন, ইউনিট, ভল্ট, ভাইস চেয়ারম্যান, ভিটামিন, ভোল্ট, ভাউচার, ওয়েবসাইট ইত্যাদি।

লেখকঃ রফিকুল বাসার

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে