ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। যদিও আমরা ইতিহাসের কথা উঠলে একটু নাকসিটকে কথা বলি, তাচ্ছিল্য করি। মানব সভ্যতার ইহিতাসে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর অত্যাচার নির্যাতনের ঘটনা কথায় কথায় আমরা বলে থাকি। কিন্তু আমরা কখনও বিশ্লেষণ করি না নাৎসি স্বৈরতন্ত্রের দর্শনও একটি উগ্রবাদী মতবাদ। যে মতবাদের হাওয়ায় অস্থির হয়েছিল গোটা বিশ্ব; প্রাণ দিতে হয়েছিল ৮ কোটি ৫০ লক্ষ নিরীহ মানুষকে।

এই উগ্র মতাদর্শের একটু যদি বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখা যায়, হিটলারের নাৎসি বাহিনী তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে প্রথমে কমিউনিস্টদের নিয়ন্ত্রণ ও নিধন শুরু করে। এতে তারা নিজের দেশের মানুষকে দুটি মেরুতে ভাগ করে ফেলতে সক্ষম হয়। এ সময় তারা বিশ্বের এন্টি কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন পায়। জার্মানবাসী কমিউনিস্ট নিধনের এ ঘটনা বিচ্ছিন্ন ও ক্ষুদ্র একটি অংশের ওপর নিয়ন্ত্রণ হিসেবে দেখেছে। এ জন্য তারা প্রতিবাদ করেনি বরং এ ঘটনার একটি মৌন সমর্থন পেয়েছে হিটলার। কমিউনিস্টদের নিধনের ও কারারুদ্ধ করার পর হিটলার সামাজিক গণতন্ত্রপন্থীদের ওপর নানা অভিযোগ এনে তাদের জেলে পুরতে থাকে। এভাবে এক পর্যায়ে জামানিতে গণতন্ত্রের পথও রুদ্ধ হয়।  এ সময়ও সাধারণ জনগণ খুব একটা প্রতিবাদ করেনি। কমিউনিস্টপন্থী ও তৎকালীন গণতন্ত্রপন্থীদের সাথে সরাসরি রাজনৈতিকভাবে জড়িত না থাকায় জনগণ হিটলারের এ নিধন বা নিয়ন্ত্রণকে যুক্তিসংগত মনে করেছিল। পাশাপাশি নিজেদের কোন রকম ঝামেলায় জড়াতে চায়নি তারা। এর ফলে হিটলার হয়ে উঠলেন ক্ষমতাধর এবং তার উগ্র মতাদর্শে নাৎসিদের ভীত তখন অনেকটাই মজবুত। আর এ সময়ে হিটলার বাহিনী তার দেশের অভ্যন্তরে যে অত্যাচার করেছে তা মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার করতেও সক্ষম হয়েছিল। যে ভীতি হল উগ্রবাদের উত্থানের অন্যতম হাতিয়ার তা যতাযথ প্রয়োগের ফলে জনগণও ভীত হয়ে পড়েছিল।

সে সময় জামার্নীতে শিল্প বিপ্লব চলছে; পাশাপাশি শ্রমিকরা অনেক বেশি সংঘবদ্ধ। ট্রেড ইউনিয়নগুলো শ্রমিক স্বার্থ রক্ষায় দৃঢ়ভাবে কথা বলতো এবং সরকারের অনেক সিদ্ধান্তের বিরোধীতাও করতো। নাৎসিবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে জার্মানের সামাজিক এই বাধাটাও অপসারণের প্রয়োজন ছিল, শুরুও হলো তাই। তৎকালীন প্রভাবশালী শ্রমিক নেতাদের গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ ও হত্যা করা হয়েছিল। এভাবেই পৃথীবীর ইতিহাসের অন্যতম উগ্রবাদের উত্থানের প্রতিবাদ করার আর কেউই রইল না। এ সব ঘটনা পর্যন্ত জার্মানবাসী মনে করেছিল তারা তো ভালোই আছে, মিছে কেন প্রতিবাদ করে বিপদে পড়বেন। যে অত্যাচারিত হচ্ছে তার নিশ্চয়ই কোন দোষ আছে, তাই তারা তেমন কোন প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি। অবশেষে যখন পুরো জার্মানীর মানুষ এই উগ্রবাদের কুফলের শিকার হতে লাগলো তখন তারা অন্যের থেকে সাহায্যের আশা করেছিল। কিন্তু হায় ততদিনে হিটলার আর তার উগ্র মতাদর্শের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কন্ঠগুলো রুদ্ব হয়ে গেছে। প্রতিবাদ ও সহযোগিতা করার কেউ নেই। জার্মানবাসীর ওই মৌনতার শিকার ও দর দিতে হয়েছে সম্পদহানী ও সেই সময়ে দুনিয়ার ৩ শতাংশ মানুষকে। অর্থাৎ ৮ কোটি ৫০ লক্ষ নিরীহ মানুষের প্রাণ দিয়ে।

বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটাও সেই সময়কার জার্মানবাসীর মতো। কোন বিষয়ে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যমত পোষণ করতে পারে না। তারা এবং আমাদের অগ্রজ জ্ঞানী মানুষেরা তত্ত্ব দিয়ে যে কোন বিষয়েই সাধারণ মানুষদের দ্বিধায় ফেলে বিভক্ত করে দেন। আমাদের দেশে সমালোচনা শব্দটা বোধ হয় হারিয়ে যেতে বসেছে। এর স্থান দখল করে নিয়েছে বিরোধীতা শব্দটি। আমার দৃষ্টিতে এ শব্দটি কোন অবস্থায় গঠনমূলক নয়, এটি একটি সংঘাতপূর্ণ শব্দ। পাশাপাশি পরমত সহিষ্ণুতার বিষয়তো এখন মিউজিয়ামে গিয়ে খুঁজতে হচ্ছে। সে যাই হোক এতসব ইতিহাস আর শব্দ বিশ্লেষণের কারণ বর্তমান প্রেক্ষাপটের বাংলাদেশে উগ্রপন্থা ও জঙ্গীবাদের কিছু বিষয় দৃষ্টি আকর্ষণ করা।

একটু পেছনে থেকে যদি দেখি তাহলে দেখা যায়, ২০০৫ সাল পরবর্তী দেশে ১০ বছরে ৪৭৯টি জঙ্গি হামলায় খুন হয়েছেন নিরীহ, নির্দোষ, সহজ, সরল, সাধারণ অন্তত ৫’শ মানুষ। জঙ্গী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ৪৭৯টি মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ১৬২টি। যেখানে মৃত্যুদন্ডও দেয়া হয়েছে অনেক অপরাধীর। বিচারাধীন আছে ৫৭টি মামলা ও ২৬০টি মামলা তদন্তাধীন। আর এসব ঘটনায় জঙ্গী সন্দেহে দেড় হাজাদেরর বেশি গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। অবশ্য ফাঁক-ফোঁকর গলিয়ে জামিনে মুক্ত হয়ে গেছে ৫’শ জনের বেশি। যারা আবারও অপরাধের সাথে যুক্ত হয়েছে। এ রকম একজন হলো নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) নেতা তরিকুল ইসলাম।  ২০০৫ সালে সারাদেশে একযোগে বোমা হামলার ঘটনায় চট্টগ্রামে গ্রেফতার হওয়ার পর জামিনে মুক্তি পায় সে। কিন্তু ২০১৫ সালের ৫ অক্টোবর রাজধানীর বাড্ডায় পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান ও কথিত পীর খিজির খানকে গলা কেটে হত্যার অভিযোগে আবার গ্রেফতার হন তিনি। ২৫ অক্টোবর আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে নিজ হাতে খিজির খানের গলা কাটার কথা স্বীকার করেন তরিকুল।

শুধু তরিকুলই নন, গত পাঁচ বছরে জেএমবির ৪২ জন, হিযবুত তাহরীরের ৪২১ জন, হরকত-উল-জিহাদের (হুজি) ১৫ জন, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ৪ জনসহ ৪৮২ ব্যক্তি জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। জামিন পাওয়ার পর এসব জঙ্গি ও নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্যরা আবারও হত্যা, নাশকতাসহ রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়াচ্ছে। তথ্য-উপাত্য বিশ্লেষণ এ রকম ইঙ্গিতই দিচ্ছে ।

২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টা-১১টার মধ্যে জেএমবি সদস্যরা মুন্সীগঞ্জ ছাড়া দেশের ৬৩ জেলার সাড়ে ৪শ’ স্থানে একযোগে প্রায় ৫শ’ বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। আর এ ঘটনার মধ্য দিয়ে নিজেদের শক্তির জানান দেয় জঙ্গি সংগঠন জেএমবি (বর্তমানে নিষিদ্ধ)। ওই ঘটনায় দু’জন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। এ ঘটনায় ১৬১টি মামলার ১০৮টির বিচার শেষ হয়েছে। এ সব মামলায় আদালত ৪৫ জনের মৃত্যুদন্ড দেয়। এর মধ্যে শীর্ষ ৬ জঙ্গী নেতার মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয় ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ। শীর্ষ এ জঙ্গী নেতারা হচ্ছে শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম, খালেদ সাইফুল্লাহ, আতাউর রহমান সানি, আবদুল আউয়াল, ইফতেখার হাসান আল মামুন। বাকি ৩৯ জনের মৃত্যুদন্ড এখনও কার্যকর হয়নি। উচ্চ আদালতে আপিল করায় তাদের রায় কার্যকর দীর্ঘদিন ধরে আটকে আছে। সারাদেশে জঙ্গিবাদের এ সব মামলায় রায় হওয়ার আগেই জামিন নিয়ে পালিয়ে গেছেন ভয়ঙ্কর ধরনের দুই শতাধিক জঙ্গী।

এর আগে ১৯৯৯ সালে যশোরের উদীচীর অনুষ্ঠানে গ্রেনেড হামলা হয়। ২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি রাজধানীর পল্টনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির(সিপিবি) সমাবেশে বোমা হামলা চালায় জঙ্গীরা। এতে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। জঙ্গিদের গ্রেনেড বোমা হামলার ধারাবাহিকতায় আরও আহমদিয়া মসজিদ, গির্জা, সিনেমা হল, সিলেটের মাজারে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের ওপর বোমা হামলা, সিলেটের মেয়র কামরান, হবিগঞ্জে সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়াকে হত্যা ও ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে গ্রেনেড হামলায় সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ প্রায় ২৪ জন নিহত হন। এই গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত হন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও।

সাম্প্রতিক বছরগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সারাদেশে ৪৯ জঙ্গি গোষ্ঠীর হামলায় প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার, প্রকাশক, শিক্ষক, পুরোহিত, মুয়াজ্জিন, ধর্মযাজক, বিদেশী, মানবাধিকার কর্মী, সেবক, দর্জি, মুদি দোকানি, পুলিশ ও পুলিশ পরিবারের সদস্য, হিন্দু, খ্রীস্টান, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও মতাবলম্বীসহ ৫২ জনের হত্যায় জঙ্গীদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ এসেছে।  আর এসব ঘটনার পর ‘ক্রসফায়ার’ নামক ঘটনা ঘটিয়ে সাময়িক সমাধানের অপচেষ্টা করা হয়েছে মাত্র। যা সামাজিক নিরাপত্তাকে আরও বেশী সাংঘর্ষিক করে তুলেছে।

মূলতঃ এসব ঘটনার পর পরই জাতীয় ঐকের মাধ্যমে উগ্রবাদ প্রতিরোধের কৌশল নির্ধারণ করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা হয়নি, হচ্ছেনা। বরং প্রতিটি ঘটনাক বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা এবং একে অপরের দিকে কাঁদা ছোড়াছুড়ি করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। এ বিষয়ের পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। প্রতিটি হত্যারপরই দেশ জুড়ে নানা কথা উঠেছে জনসাধারনের নিরাপত্তা নিয়ে। আর সমাধানের পথ না খুঁজে নিজেদের ভোটের রাজনীতি ও জনপ্রিয়তা বাড়াতে রাজনৈতিক দলগুলি তর্কে জড়িয়ে জনগণকে বিভক্ত করেছে। কখনও হত্যার শিকার হওয়া ব্যক্তিকে নাস্তিক বলে প্রকৃত ঘটনা থেকে ঘটনাকে আড়াল করা হয়েছে খুনিদের। আবার কখনও হত্যাকান্ডগুলোকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন ও বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে গুরুত্ব বাড়ানো বা হালাকা করার অপচেষ্টা হচ্ছে। ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো সমালোচনা করছে ঢালাওভাবে এবং এ সব হত্যাকান্ডকে পুঁজি করে জনসমর্থন আদায়ে সচেষ্ট। এর ফলে সাধারণ জনগণ বিভ্রান্ত হয়েছে এবং এখনও বিভ্রান্তির মধ্যেই রয়েছে। আর এভাবেই খুনিদের জন্য সৃষ্টি হচ্ছে অনুকূল পরিবেশ ।

প্রশ্ন হলো, আমরা কি এখনও এ বিষয়ে কাদা ছোঁড়াছুড়ির মধ্যে থাকবো, নাকি সমাধানের পথে হাটবো। আমরা কি কেবল মাত্র ব্যক্তিকেন্দ্রিক নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করবো, নাকি সমাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবো?  এ সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা ও সমাধান জরুরী। অন্যথায় জনগণের অনৈক্য ও রাজনৈতিক দলগুলোর অদূরর্দশীতা ও আত্মকেন্দ্রিক আচরণের মাধ্যমে উগ্রবাদের উত্থানের যে পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে তার দায় সকলকেই নিতে হবে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শিকার হতে হবে এ দেশের সকলকেই একদিন; সে দিন আর কথা বলার ও প্রতিবাদ করার কেউই হয়তো অবশিষ্ট থাকবো না। আমরা বাংলাদেশে বর্তমান ও ভবিষ্যতকে কিভাবে দেখতে ও গড়তে চাই সে সিদ্ধান্ত আমাদেরই নিতে হবে। কোন এলিয়েন অথবা আলাদিনের দৈত্য এসে আমাদের সমস্যার সমাধান করবে এটা ভাবার কোন অবকাশ নেই। আছে কি?

লেখক: আবু হেনা মোস্তফা জামাল, গণমাধ্যম কর্মী

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে