সদ্য দেশ স্বাধীন-উত্তর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে কোটিপতি ছিল মাত্র ৫ জন। সেই থেকে শুরু করে গত ৪৬ বছরে কোটিপতির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় লক্ষগুণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী গত অর্থবছরে দেশে কোটিপতির সংখ্যা ৬৮ হাজার ৮৯১ জন। এর আগের বছরে অর্থাৎ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এই সংখ্যা ছিল ৬২ হাজার ৪১৮ জন। গত এক বছরে বেড়েছে ৬ হাজার ৪৭৩ জন।
দেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা ৬টি কারণ চিহ্নিত করেছেন। তারা মনে করেন, ৭/৮ বছর আগে যারা ব্যাংকে ফিক্সডিপোজিট করে টাকা রেখেছিল সেগুলো দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এছাড়ার কোটিপতি বাড়ার কারণ আমাদের অর্থনীতি কল্যাণমুখী অর্থনীতি থেকে পুঁজিবাদী অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
এছাড়া ধনীরাই ব্যাংকের বেশিরভাগ আমানতের জোগান দেয়। আমাদের মুদ্রানীতিতে বলা হচ্ছে, যে কোনো উৎস থেকে, যে কোনোভাবে টাকা রোজগারই আমাদের উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে আমরা মূলত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিই অনুসরণ করছি। দেশে বিনিয়োগের ভালো পরিবেশ নেই এ কারণে লোকজন ব্যাংকে টাকা রাখছে। আর এসব কারণে কোটিপতির হিসাব বাড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষের কাছে ৪০ শতাংশের বেশি সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়ায় দেশে আয় বৈষম্য অনেক বেড়ে গেছে। ধনী-গরিবের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। যা শোষণের পর্যায়ে পড়ে। যেটা বঙ্গবন্ধুর শোষণমুক্ত রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্নের বিপরীতে বেমানান। তবে অনেক কোটিপতিই সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের কল্যাণে কাজ করছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সকল তফসিলি ব্যাংকের কাছ থেকে প্রাপ্ত হিসাবের ভিত্তিতে যে প্রতিবেদন তৈরি করে সেটাই কোটিপতির সংখ্যা নির্ধারণের নির্ভরযোগ্য ভিত্তি। এটা শুধু কাগজে-কলমে এবং ব্যাংকে গচ্ছিত আর্থিক স্থিতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি। অন্যান্য দিক ও সম্পদের বিবেচনায় এই সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে বলে মনে করছেন ব্যাংক ও অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।
জানা গেছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর শুরুর ১০-১৫ বছর কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে ধীরগতিতে। ১৯৯০ সালের পর থেকে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে যেন অশ^ গতিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি অ্যাকাউন্টধারী ছিল মাত্র ৫ জন। ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর শেষে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৭ জনে। ১৯৮০ সালের ডিসেম্বরে ছিল ৯৮ জন। আলোচ্য সময়ে আমানতের পরিমাণ ছিল সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতের মোট আমানতের ১০ শতাংশ। এরপর ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৪৩ জনে।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালের জুনে কোটিপতির সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৫৯৪ জন। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর শেষে কোটিপতির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ হাজার ১৬২ জনে। এরপর অক্টোবর ২০০১ থেকে ডিসেম্বর ২০০৬ পর্যন্ত কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছিল ৮ হাজার ৮৮৭ জনে। অর্থাৎ এ সময়ে কোটিপতির সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১৪ হাজার জনে। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ২ বছরে অর্থাৎ ২০০৭-০৮ সালে বেড়েছিল ৫ হাজার ১১৪ জন। এ সময়ে কোটিপতির সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১৯ হাজারের বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ২০০৯ সালের মার্চে দেশে ব্যক্তিপর্যায়ে কোটিপতি অ্যাকাউন্ট ছিল ১২ হাজার ৯১৭টি। ২০১৪ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার ৬৮৭টিতে। সে হিসেবে এই ৬ বছরে দেশে ব্যক্তিপর্যায়েই কোটিপতি অ্যাকাউন্ট বৃদ্ধি পায় প্রায় ২৭ হাজার ৭৭০টি। প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ২১৫ শতাংশ। অন্যদিকে ২০০৯ সালের মার্চে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক মিলে ব্যাংকে কোটি টাকার ঊর্ধ্বে অ্যাকাউন্ট ছিল ১৯ হাজার ৬৩৬টি। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৪ হাজার ৭২৭টিতে। সে হিসাবে ৬ বছরে দেশে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় মিলে কোটিপতি অ্যাকাউন্ট বৃদ্ধি পায় প্রায় ৩৫ হাজার। প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ১৭৮ শতাংশ। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশে মোট কোটিপতির সংখ্যা ছিল ৪৪ হাজার ৩৬৯ জন।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৭ বছরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে সব থেকে বেশি। প্রায় ৫৬ হাজার জন। এর মধ্যে আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে ৩০ হাজার ৪৭৭ জন এবং ঋণগ্রহীতার সংখ্যা বেড়েছে ২৩ হাজার ৭৪৫ জন। এর কারণ হিসেবে তারা মনে করেন, ব্যাংকিং চ্যানেলে কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও গ্রাহক কারসাজি করে বেশকিছু বড় অঙ্কের টাকা লেনদেন করে। এরই প্রভাবে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে থাকতে পারে।
এদিকে অতি ধনীদের সম্পদ নিয়ে গবেষণাকারী সংস্থা যুক্তরাজ্যভিত্তিক নাইট ফ্রাংক চলতি বছরের শুরুর দিকে ‘দ্য ওয়েলথ রিপোর্ট ২০১৬ : দ্য গ্লোবাল পারসপেক্টিভ অন প্রাইম প্রপার্টি অ্যান্ড ওয়েলথ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে কোটিপতি রয়েছেন প্রায় ১১ হাজার, যাদের নিট সম্পদ ৭ কোটি ৮০ লাখ টাকার (১০ লাখ ডলার) বেশি। এছাড়া হাজার কোটি টাকার নিট সম্পদের মালিক রয়েছেন ১৫ জন। তবে স্বীকৃত কোনো বিলিয়নিয়ার বাংলাদেশে নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশে কোটিপতির অ্যাকাউন্ট বাড়ার অর্থ আমাদের সম্পদ ক্রমেই কিছুসংখ্যক লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে। এতে ধনী-গরিব বৈষম্য বাড়ছে। তিনি বলেন, আবার উন্নয়ন যা হচ্ছে, তার বেশিরভাগই শহরকেন্দ্রিক। এ কারণে মুষ্টিমেয় কিছু লোক উন্নয়নের সুফল ভোগ করছেন। এতে নিচের দিকের মানুষ বরাবরই উন্নয়নবঞ্চিত থাকছেন।
নিউজ ডেস্ক, বিডি টাইম্স নিউজ