জহির সিকদার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সংবাদদাতা।। ৯০ বছর বয়সি মো. নূরুল ইসলাম  বসে আছেন বেশ কয়েকঘণ্টা ধরে দূর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত এরশাদুলের লাশ আসার অপেক্ষায় । ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তিনি বলেন, পুলাডা খুব বালা আছিলো গরীব লোকজনরে খুব সাহায্য করতো। ইলেকশন করতে পারলে পাস করতো কারন তার পক্ষে ১১ গেরামের মানুষ আছলো।’

এরশাদুলের প্রশংসা করে মো. আরশ মিয়া নামে আরেক বৃদ্ধ বলেন, ‘লেহাপড়া জানা পুলা। খুব বালা আছলো। দেখলেই আমারে ডাক দিয়া জিগাইত। মার্কা ছাড়া অই হে পাস করলো অইলে। বাফের চেয়ারম্যানিডা চালাইতে চালাইতে অভিজ্ঞতা অইয়া গেছল গা।’ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে শুক্রবার রাতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে খুন হওয়া মো. এরশাদুল হক সম্পর্কে এমনই আলাপচারিতা করছেন ঐ দুই বৃদ্বের মত পুরো এলাকার লোকজন। মূলত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে পরিকল্পিতভাবে এরশাদুলকে হত্যা করা হয়েছে বলে এলাকাবাসী সুত্রে জানা যায়। এরশাদুলের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। উল্লেখ্য যে,  ষষ্ঠ ধাপে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার নাটঘর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। নাটঘর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আবুল কাশেমের ছেলে এরশাদুল বাবার অসুস্থতাজনিত কারণে এ ইউনিয়ন পরিষদ থেকে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়ে প্রচারণা শুরু করেছিলেন। ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও নান্দুয়া গ্রামের বাসিন্দা এরশাদুল ঘটনার কিছু সময় আগেও দুটি ওয়াজ মাহফিলে বক্তব্য রেখে চেয়ারম্যান প্রার্থী হওয়ার কথা উল্লেখ করে নিজের জন্য দোয়া চান। এর একটু পর বাদল সরকার নামে একজনকে সঙ্গে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে আসছিলেন এরশাদুল। সন্ত্রাসীরা প্রথমেই বাদল সরকারকে (২৩) গুলি করলে ঘটনাস্থলেই তিনি নিহত হন। পরে ঢাকায় নেওয়ার পথে মারা যান এরশাদুল। নিহত বাদল সরকার ব্যবসায়িকসহ ব্যক্তিগত বিভিন্ন কাজে এরশাদুলকে সহায়তা করতেন। নান্দুয়া গ্রামের সন্তোষ সরকারের ছেলে বাদল সরকার ছিলেন এরশাদুলের প্রতিবেশীও।

উপজেলার নাটঘর ইউনিয়নের কুড়িঘর বাজার এলাকায় শুক্রবার রাত পৌনে ১০টার দিকে হামলার শিকার হন এরশাদুল ও বাদল। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা মতে, মোটরসাইকেলে করে আসা লোকজন খুব কাছ থেকে তাঁদেরকে গুলি করে। এ ঘটনায় পুলিশ একজনকে আটক করলেও তার নাম প্রকাশ করতে চাচ্ছেন না। ঘটনাস্থল থেকে গুলির চারটি খোসা উদ্ধার করা হয়। শনিবার রাত ৮টা নাগাদ এ বিষয়ে থানায় কোনো মামলা হয়নি। পরিস্থিতি বিবেচনায় এলাকায় পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। দুজনকে হত্যার ঘটনার রেশ ধরে প্রতিপক্ষের বেশ কয়েকটি বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়েছে। ঘটনার পর হতে এরশাদুল ও বাদলের বাড়িতে শত শত মানুষের ঢল নেমেছে।  শোকের মাতমে  নিহত দুজনের বাড়ির পরিবারের একাধিক সদস্য বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন বলে সুত্রে জানা গেছে।
স্থানীয় সুত্রে জানা যায়,এরশাদুল হকের চাচাতো ভাই মো. সাইফুল্লাহকে ২০১৯ সালের জুলাই মাসে হত্যা করা হয়। ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলার বাদী ছিলেন এরশাদুল। ২০ জনকে আসামি করে দায়ের করা মামলায় গ্রামের আধিপাত্যের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। চেয়ারম্যান নির্বাচনের পাশাপাশি পূর্বের ওই বিরোধও হত্যাকাণ্ডের কারণ বলে অনেকে মত দেন। এরশাদুলের বিরুদ্ধেও নবীনগর থানায় দুটি মামলা রয়েছে বলে পুলিশের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।

মো. ইসমাইল নামে এরশাদুলের এক চাচাতো ভাই বলেন, ‘ওয়াজে বক্তব্য দিয়ে ভাই আমাদেরকে হেঁটে চলে যেতে বলেন। বাসায় আসার পরপরই শুনি ভাইকে গুলি করা হয়েছে। আমি তখন ঘটনাস্থলের দিকে যেতে চাইলে এলাকার মুরুব্বিরা বাধা দেন। রাতে ভাই মারা যান। মূলত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।’ এরশাদুলের চাচাতো ভাই কাতার প্রবাসী মো. আক্তারুজ্জামান নিজেকে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে দাবি করেন। তিনি জানান, এরশাদুলকে বহনকারী মোটরসাইকেলের ঠিক পেছনেই আরেকটি মোটরসাইকেলে ছিলেন তিনি। সেই মোটরসাইকেলের আলোয় দেখতে পারেন কয়েকটি মোটরসাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ১৫ জনের মতো লোক হুট করে দুই পাশ থেকে গুলি শুরু করেন। দৌঁড়ে এসে তাদেরকে ধরতে না পারলেও কয়েকজনকে তিনি চিনতে পেরেছেন। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা এ ধরণের ঘটনা ঘটাতে পারে বলে তিনি অভিযোগ করেন। বেলা ৩টার দিকে বাদল সরকারের লাশ বাড়ির সামনে এনে রাখা হয়। সেখানেই কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন  বাদলের মা ও বোন রিতু। ‘আমার বাবা কই, আমার সোনা কই’ বলে বাদলের মা হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। বাদল সরকারের মামাতো ভাই যতন সরকার বলেন, ‘আমার ভাই সৌদি যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ভিসার প্রক্রিয়াও প্রায় শেষ। বাড়িতে থেকে তিনি এরশাদুল ভাইয়ের বিভিন্ন কাজ দেখাশুনা করতেন। শুক্রবার রাতে হুট করে শুনি তাঁকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে।’

এদিকে, স্বামী হারানো বেদনায় বার বার জ্ঞান হারাচ্ছিলেন এরশাদুলের স্ত্রী সুমী বেগম। দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তিনি কিভাবে কি করবেন সেটা বলে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তিনি জানান, দেবর এসে গুলি করে এরশাদুলকে হত্যা কথা জানায়। কাঁদতে কাঁদতে মা রওশনারা বেগম বলেন, ‘আমার পুতের তো কোনো শত্রু নাই। হেরা কেরে মারলো আমার পুতেরে।’ ঘটনার কিছুক্ষণ আগে ছেলে আলভীকে নিয়ে এরশাদুল দাওয়াত খেতে যায় বলে জানান তিনি। এরপরই গুলি করে হত্যার খবর জানতে পারেন। এরশাদুলের বাবা নাটঘর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল কাশেম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র বেশ কয়েকজন প্রার্থী এখানে আছে। তবে কারো সঙ্গে আমরা বিরোধ করি না। তবে কেউ কেউ বিভিন্ন কথা বলে বেড়ায়। আমার ছেলের জনপ্রিয়তা বুঝতে পেরে এ ধরণের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। আমি এর বিচার চাই।’

ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিউজ ডেস্ক।। বিডি টাইমস নিউজ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে