প্রতিটি মানুষের জন্ম তার স্বজাতীর জন্যে এক বড় সুসংবাদ বয়ে আনে এবং এ মানব সন্তানই অজানা ইতিহাসের গড়ার মূল কারিগরের ভূমিকা পালন করে। কালের পরিক্রমায় মানব সন্তানের প্রতিভা লুকিয়ে জন সম্মুখে প্রকাশ পায়। যদিও কখনো কখনো কুঁড়ি থেকে ফুল ফোটার আগে তা ঝরে যায়। তা মূলত স্থান কাল পাত্র ভেদে ও সমাজের অবস্থার উপর নির্ভর করে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতায় লিখেছিলেন, “যখন তুমি এসেছিলে ভবে, কেঁদেছিলে তুমি হেসেছিলো সবে। এমন জীবন তুমি করিবে গঠন, মরিলে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন। গুণিজনদের সাথে কবি নজরুলের এ পংক্তি মিলে যায়। বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামে যে সকল সন্তান, বীর মুক্তিযোদ্ধা, ভাষা শহীদ, এবং বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় জীবন বিসর্জন দিয়েছে, তাদের হারিয়ে জাতি ভারাক্রান্ত ও ব্যথিত। যদিও তাঁদেরকে হারিয়ে জাতি শোকাহত। কিন্তু তাঁদের হারানোর শোককে জাতি শক্তিতে রুপান্তরিত করে সামনে এগিয়ে চলছে।
এ বসুন্ধরাতে যুগে যুগে গুণীজন জন্ম নিয়েছে মূলত মানুষকে সঠিক পথের নির্দেশনা ও করণীয় সম্পর্কে সচেতন করে তোলার জন্যে। তাঁদের কাছে কোনো ধরনের অস্ত্র ও আনবিক শক্তি ছিলো না। কিন্ত তাঁদের লেখনি শক্তি ও বক্তব্যের প্রতিধ্বনিতে সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি ও অত্যাচারী শাসকদের সা¤্রাজ্য কেঁপে উঠেছে। তাঁদের লেখনী শাসকগোষ্ঠী ও পেশীশক্তির কাছে গোলাবারুদ ও অস্ত্র থেকেও ভয়ঙ্কর মনে হয়েছে। কবি, সাহিত্যিক, নেতা ও সমাজের গুণীজন সংখ্যায় কম হলেও তাঁদের লেখনি ও চিন্তার মাধ্যমে দেশের আপামর জনসাধারণ বৈষম্য ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছে। ফলত, শাসকগোষ্ঠী তাঁদের বিভিন্নভাবে দমন করতো এবং যুদ্ধের মূহুর্তে বুদ্ধিজীবীদের ভীতিপ্রদর্শনের পাশাপাশি হত্যা করতো। যদিও তাঁরা ভুলে যেতো গুণিজনের উত্তরসূরীরা যুগে যুগে জন্ম নেয়। বাংলাদেশে এ রকম গুণীজন মুক্তিযুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য বধ্যভূমি ও বুদ্ধিজীবি স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। কিছু কিছু বধ্যভূমি ও বুদ্ধিজীবি স্মৃতিস্তম্ভ রক্ষণাবেক্ষণ করা হলেও আবার কিছুক্ষেত্রে দেখা যায় ভিন্নচিত্র। আবার কখনো কখনো দেখা যায় প্রতিবছর ১৪ই ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে ঐ সকল স্থান ও স্মৃতিস্তম্ভ পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন করা হয়। মূলত আমাদের উচিত কোন দিবসে তাঁদের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন সীমাবদ্ধ না রেখে সারাবছর আমাদের নির্দিষ্ট সময়ে তাঁদের আতœত্যাগের ইতিহাস পর্যালোচনা করা এবং সময় বের করে বধ্যভূমি ও স্মৃতিস্তম্ভ পরিদর্শন করা। তাঁদের বংশধর, জীবিত মুক্তিযোদ্ধা, ইতিহাস বিশ্লেষক ও গবেষকদের সাথে এ বিষয়ে কথা বলা। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, “যে দেশে গুণীর কদর নেই সে দেশে গুণীর জন্ম হয় না। সুতরাং গুণীজনদের সম্মান ও তাঁদের ইতিহাস জানা আমাদের সকলেরই কর্তব্য।
দীর্ঘ নয় মাস যু দ্ধ অতিবাহিত হওয়ার পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন বুঝতে পেরেছিলো যে তাদের পরাজয় নিশ্চিত। তখন এ শত্রæপক্ষ দেশের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় এবং এ দেশের বিজ্ঞজনদের বাছাই করে হত্যা করে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কতজন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিলো তা নিয়ে গবেষক ও মুক্তিযুদ্ধ বিশ্লেষকদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। এ নিয়ে আরো বিস্তৃত গবেষণা করা প্রয়োজন। কারো কারো মতে, মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র দেশে ১১১১ (এক হাজার একশত এগার) জনকে হত্যা করা হয়েছিলো। তন্মোধ্যে রাজশাহীতে ৫৪ (চুয়ান্ন) জন, বরিশালে ৭৫ (পঁচাত্তর) জন, খুলনাতে ৬৫ (পয়ষট্টি) জন, চট্টগ্রামে ৬২ (বাষট্টি) জন, ফরিদপুরে ৪৩ (তেতাল্লিশ) জন, ময়মনসিংহে ৭৫ (পঁচাত্তর) জন, পাবনাতে ৫৩ (তেপান্ন) জন, দিনাজপুরে ৬১ (একষট্টি) জন, যশোরে ৯১ (একান্নব্বই) জন, কুমিল্লায় ৮৬ (ছিয়াশি) জন, রংপুরে ৭২ (বাহাত্তর) জন এবং ঢাকাতেই ১৪৯ (একশত উনপঞ্চাশ) জন। ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাÐের শেষ অধ্যায়টি সম্পন্ন হয়েছিলো ঢাকাসহ সমগ্র দেশে। সেদিন ধরে নিয়ে যাওয়া হয় শহীদুল্লাহ কায়সার, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা ও মুনির চৌধুরীসহ আরোও অনেককে। তারপর তাদের মধ্যে থেকে কারো কারো লাশ খুঁজে পাওয়া যায় বধ্যভূমিতে। আবার কাউকে আর কখনোই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়, রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুর, মিরপুর এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিলো। মূলত মুক্তিযুদ্ধের এক সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত এ বিজয় অর্জন করতে অনেক তাজা প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চ লাইটের মাধ্যমে যে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিলো তা শেষ হয় ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে আরো বৃহৎ পরিসরে গবেষণা করা প্রয়োজন। ১৪ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী দিসব নির্ধারণ করার পেছনে যুক্তি উপস্থাপন করে ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন, “১৪ই ডিসেম্বরটাকে করা হয়েছে এই কারণে যে, বিজয় দিবস হচ্ছে ১৬ই ডিসেম্বর। ১৪ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছে।” ঢাকায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিস্তম্ভে সম্মান প্রদর্শন করার পাশাপাশি সমগ্র বাংলাদেশে এ দিবসটি অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার সাথে পালন করা উচিত।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রংপুর ভৌগলিক ও কৌশলগত কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। এখানে স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়কদের পাশাপাশি ৭২ (বাহাত্তর) জনকে হত্যা করা হয়। রংপুরের মুক্তিকামী জনতা ৩রা মার্চই প্রথম যুদ্ধ শুরু করে। এ অঞ্চলে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম শহীদ ছিলো শংকু সমজদার। ১৯৭১ সালের ৩রা এপ্রিল মধ্যরাতে রংপুরে প্রথম গণহত্যা হয় দখিগঞ্জে। এখানে হত্যা করা হয় যথাক্রমে ওয়াই এ মাহফুজ আলী জররেজ, এহসানুল হক দুলাল, রফিকুল ইসলাম রফিক, তোফাজ্জল হোসেন মহরম, পাগলা দরবেশ, ক্ষীতিশ হালদার, শান্তি চাকী, দুর্গাদাশ অধিকারী, গোপাল চন্দ্র এবং উত্তম কুমার অধিকারী গোলাপ। অন্যদিকে ৩০ শে এপ্রিল রংপুর ঢাকা মহাসড়কের দমদমা ব্রীজের কাছে হত্যা করা হয় কারমাইকেল কলেজ, রংপুর এর ৪ (চার) জন শিক্ষক যথাক্রমে অধ্যাপক সুনীল বরণ চক্রবর্তী, অধ্যাপক রামকৃষ্ণ অধিকারী, অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন রায় এবং অধ্যাপক কালাচাঁদ রায়। এছাড়াও আরো কিছু স্থানে গণহত্যা সংঘটিত হয় যথাক্রমে জাফরগঞ্জ, নিসবেতগঞ্জ, ঘাঘটপাড়, লাহিড়ীরহাট, সাহেবগঞ্জ, জয়রাম আনোয়ার মৌজা, পদ্মপুকুর, ঝাড়–দার বিল, বলারখাইল প্রমুখ স্থানে। নব্দীগঞ্জ, নিসবেতগঞ্জ ও দমাদমা ব্রীজের বধ্যভূমিতে বুদ্ধিজীবী, সৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা ও অনেক সাধারণ মানুষকে রাতের আঁধারে হত্যা করা হয়। এছাড়াও রংপুরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মুখতার ইলাহীর নামও জড়িত। তাঁকে যেখানে হত্যা হয় সেই লালমনিরহাটে আইরখামারেও গণহত্যা সংঘটিত হয়।
যে সকল গুণীজন দেশের জন্যে জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের স্মৃতিস্তম্ভ ও বধ্যভূমি পরিদর্শন করার পাশাপাশি তাঁদের বিদেহী আতœার মাগফেরাত কামনা করা দরকার। বধ্যভূমি ও স্মৃতিস্তম্ভ রক্ষণাবেক্ষণ করার পাশাপাশি কোন অব্যবস্থাপনা থাকলে তা স্থানীয় প্রশাসনকে জানানোর মাধ্যমে তা রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত। এ দিবসে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি রইলো বিন¤্র শ্রদ্ধা।
লেখক- মোঃ হাবিবুর রহমান
গবেষক ও কথাসাহিত্যিক