রোকেয়া খাতুন (১৮৮০, ৯ ডিসেম্বর – ১৯৩২, ৯ ডিসেম্বর) কালের পরিক্রমায় হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি মুসলিম
নারী জাগরণের অগ্রদূত ও বাঙালি নারী সাহিত্যিক। তিনি বেগম রোকেয়া ও রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নামে
সমধিক পরিচিত। তাঁর রচিত গ্রন্থ যথাক্রমে পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, মতিচুর এবং “Sultana’s Dream”
প্রকাশের মাধ্যমে নারী সমাজকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলা ও করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বিবিসি বাংলার জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে ষষ্ঠ স্থানে নিজেকে অলংকিত করেছেন।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তাঁর সমসমায়িক নারীদের মধ্যে আধুনিক চিন্তাধারার মানুষ ছিলেন। তিনি ‘বায়ুযানে
পঞ্চাশ মাইল’ অনুচ্ছেদে লিখেছেন, ‘২৫ বছর পূর্বে লিখিত “সুলতানার স্বপ্নে বর্ণিত বায়ুযানে স্বপ্নকে সফল করতে পেরেছিলাম’। প্রথম মুসলিম অবরোধ-বন্দিনী নারী হিসেবে প্লেনে করে আকাশে উড়াল দিতে পেরেছিলেন। ১৯৩০ সালের ২ ডিসেম্বর বেলা প্রায় ৪ টার সময় তিনি প্লেনে পঞ্চাশ মাইল ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। তিনি বঙ্গের প্রথম মুসলিম পাইলট ও তাঁর বোনের ছেলে মোরাদ-এর বায়ুযানে ভ্রমণ করলেন। এ প্লেনটি প্রায় ৩,০০০ (তিন হাজার) ফিট উর্ধ্বে উঠেছিলো এবং ৫০ মাইল উড়েছিলো। উল্লেখ্য যে, তাঁর পূর্বে যে ক’জন মুসলিম মহিলা এরোপ্লেনে উঠিয়াছিলেন, তাঁরা সাধারণত ইউরোপীয়ান পাইলটের সঙ্গে আকাশ ভ্রমণ করেছিলেন।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন-এর জীবনে দুই জন পুরুষ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালক করেছিলেন যথাক্রমে তাঁর বড় ভাই ইব্রাহিম সাবের এবং তাঁর স্বামী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন। আধুনিক চিন্তাধারার
অধিকারী তাঁর বড় ভাই ইব্রাহিম সাবের-এর ঘরেই গোপনে তাঁর এ বোনকে বাংলা ও ইংরেজি শেখান। তাঁর স্বামী
ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের আগ্রহে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন এবং ১৯০২ সালে ‘পিপাসা’
গল্প লেখার মাধ্যমে সাহিত্যাঙ্গনে পথচলা শুরু করেন। ফলত, নারীদের প্রতি পুরুষদের অনেক দায়িত্ব রয়েছে।
জেন্ডার দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক করার জন্যে সবার প্রতি সবার আন্তরিক ও সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে সমাজে
পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার সংস্কৃতি পরিবর্তন করতে হবে।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারীদের মানসিক এবং অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করার জন্যে তাঁর লেখনি ও
একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন। তিনি নারীদের শিক্ষা প্রচারের জন্যে ভাগলপুওরে
‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও তিনি নারীদের আর্থিকভাবে সাবলম্বি ও পরনির্ভরশীলতা কমানোর জন্যে ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ প্রতিষ্ঠা করেন। রোকেয়া সাখাওয়াত
হোসেনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে পুরুষের পাশাপাশি বাংলার নারী সমাজ উদ্যোক্তা, শিক্ষাবিদ, গবেষক, সাংবাদিক,
খেলোয়ার, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ ইত্যাদি বিভিন্ন পেশায় কাজ করে যাচ্ছে।

রোকেয়া রংপুরস্থ মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মস্থানে যে ঘরটিতে তিনি
থেকেছেন এবং জানালায় মোমবাতি রেখে রাতে পড়াশোনা করেছেন যে জানালাটির দেয়ালটি আজোও কালের সাক্ষী হয়ে দন্ডায়মান আছে। সম্পূর্ণ দালানটির তিনটি ধ্বংসাবশেষ দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর জন্মস্থানের পাশেই নির্মাণ করা হয়েছে বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র। এ স্মৃতিকেন্দ্রে নারীদের জন্যে স্বাবলম্বি হওয়ার জন্যে

বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য যে সেলাই মেশিন রয়েছে তা চালু রাখার মাধ্যমে নারীদের সাবলম্বি করা যাবে। এ
স্মৃতিকেন্দ্রের সেমিনার কক্ষ, গবেষণা কক্ষ ও গ্রন্থাগার প্রানবন্ত করার জন্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরো উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে গ্রন্থাগারে বইয়ের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি পর্যাপ্ত বেগম রোকেয়ার রচনাবলী সংগ্রহ করলে দর্শনার্থী, পাঠক এবং গবেষকদের জন্যে উপকৃত হবে। এছাড়াও বেগম রোকেয়ার রচনাবলী বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। উল্লেখ্য যে, আইনি জটিলতার কারণে এ স্মৃতিকেন্দ্রটি এখনো পরিপূর্ণভাবে চালু করা সম্ভব হয়নি। এ ব্যাপারে সংস্কৃত মন্ত্রণালয়, বাংলা একাডেমি এবং বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে বর্তমান সমস্যা সমাধান সম্ভব।

রোকেয়ার নামে বাংলাদেশে এবং রংপুর অঞ্চলে অনেক প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়েছে। বর্তমানে রংপুরের
বাতিঘর হিসেবে খ্যাত রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়েছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর। এ
বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীর ভর্তিও সন্তোষজনক। উল্লেখ্য যে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমানে উপ-উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন প্রফেসর ড. সরিফা সালোয়া ডিনা। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে নারী সমাজকে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করতে হবে। এছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদে
নারীরা আসীন আছেন।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন-এর দেহাবশেষ রংপুরে স্থানান্তর করার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
তাঁকে সমাহিত করা হয় গঙ্গা নদীর তীরবর্তী পানিহাটি গ্রামে। দেহাবশেষ স্থানান্তরের ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে
প্রতিশ্রুতি দিলেও তা এখনো আলোর মুখ দেখে নি। উল্লেখ্য যে, রংপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক বিএম
এনামুল হক তাঁর মরদেহ আনার ব্যাপারে ২০০৯ সালের ৯ ডিসেম্বর রোকেয়া মেলায় একাত্বতা ঘোষণা দিয়ে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। যদিও তিনি ২০১০ সালে পায়রাবন্দে দেহাবশেষ
আনার বিষয়ে বিভিন্ন দপ্তর বিশেষ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছিলেন বলে জানিয়েছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে আর কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি এবং পায়রাবন্দে তাঁর মরদেহ এখনোও স্থানান্তর করা হয়নি। সুতরাং এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্যে সংশ্লিষ্ট সকলকে উদ্যোগী হতে হবে।

 লেখক,মোঃ হাবিবুর রহমান
গবেষক ও কলামিষ্ট
ই-মেইল: mirmohammadhabib@gmail.com

বিডি টাইম্‌স নিউজ

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে