জহির সিকদার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি।। আধিপত্য বিস্তারসহ নানান বিষয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাকে নিয়ে সমালোচনার শেষ নেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আর এসব সংঘর্ষের মধ্যে জেলার সবচেয়ে জঘন্যতম ও নারকীয় ঘটনাটি ঘটেছে নবীনগরে।

কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের থানাকান্দি গ্রামে আধিপত্য নিয়ে সংঘর্ষে মোবারক মিয়া নামের এক রিকশা চালকের পা বিচ্ছিন্ন করে জয়বাংলা শ্লোগান দিয়ে মিছিলের ঘটনায় দেশজুড়ে সমালোচনার সৃষ্টি হয়। গত এপ্রিল মাসে প্রতিপক্ষের হামলায় পা বিচ্ছিন্ন মোবারক মিয়া (৪৫) নিহত হয়। নিহত মোবারকের স্ত্রী ও একটি ছোট ছেলে সন্তান ছাড়া পরিবারের কেউ না থাকায় খুনের ঘটনায় ৬ দিন পর ১৫২ জনকে আসামী করে চাচাতো ভাই চাঁন মিয়া বাদী হয়ে নবীনগর থানায় একটি হত্যা মামলা করে।

এই হত্যাকান্ডের মামলা নিয়ে এলাকায় বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। পা কেটে নিয়ে হত্যাকান্ডের ঘটনাটি উপজেলার কৃষ্ণনগর ইউপি চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান ও একই ইউনিয়নের কাউসার মোল্লার মধ্যে বিরোধের জেরে সংঘর্ষে ঘটে। ঘটনার পর পরই পুলিশের তৎপরতায় দুইদলের প্রধানকে আটক করে।এই সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা মামলায় দুই পক্ষের দুইজন নেতা বর্তমানে জেলে আছেন। জেলে আটক একপক্ষের দলনেতা কাউসার মোল্লাকে পরে হত্যা মামলায়ও ২নং আসামী করা হয়েছে। কিন্তু এই হত্যা মামলা প্রধান আসামী করা হয়েছে পাশের বীরগাও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কবির আহমেদকে এবং তার ভাই আলমগীরকে করা হয়েছে ২৬নং আসামী। এতে হত্যা মামলার ন্যায় বিচার হওয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। চলছে রাজনৈতিক খেলা।

সরেজমিনে ওই এলাকায় গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কৃষ্ণনগরের বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান ও কাউসার মোল্লার বিরোধ দীর্ঘদিনের। এই বিরোধের জেরে জোড়া খুন সহ একাধিক হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। মামলাও চলছে পাল্টা-পাল্টি। কিন্তু এই বিরোধ এই ইউনিয়নের মধ্যে থেমে থাকেনি।

রাজনৈতিক ও আধিপত্যকে কেন্দ্র করে এর রেশ চলে যায় পাশের ইউনিয়ন বীরগাঁওয়ে। কারণ, বর্তমান ও সাবেক সাংসদের সমর্থকদের ঘিরে। গত উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে কাজ করছিলেন বর্তমান এমপি ও তার অনুসারীরা। ইউপি চেয়ারম্যান কবির আহমেদ সাবেক সাংসদ ফয়জুর রহমান বাদলের অনুসারী। বীরগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান কবির আহমেদ সমর্থন দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীকে। ওই ইউপিতে চেয়ারম্যান ও এমপির অনুসারীদের বিরোধ চরমে। এমপির অনুসারী পাশের কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান, বীরগাঁওয়ের ইউপি আ্#৩৯;লীগ সভাপতি হোসেন সরকার ও আফজাল হোসেন বীরগাঁওয়ে বাইশমৌজা বাজার দখলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেন। এরই মাঝে পাশের ইউনিয়ন কৃষ্ণনগরের থানাকান্দি গ্রামে গত ১২এপ্রিল স্থানীয় কাউসার মোল্লা ও ইউপি চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমানের সমর্থকদের মাঝে সংঘর্ষ হয়। এতে চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমানের পক্ষের মোবারক মিয়া নামের এক ব্যক্তি পা কেটে নিয়ে যায়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থা সে মারা যায়। ঘটনার পর দ্রুত গ্রেফতার করা হয় ঘটনার দুই প্রধান হুতাকে। কিন্তু কৃষ্ণনগর ইউপির ঘটনায় প্রধান আসামী করা হয় পাশের ইউপি চেয়ারম্যান কবির আহমেদ ও তার ভাই আলমগীরকে। এনিয়ে ওই এলাকায় চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে।

এই বিষয়ে হত্যা মামলার প্রধান আসামি বীরগাঁও ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান কবির আহমেদ মুঠোফোনে বলেন, সংঘর্ষের দিন আমি আমার এলাকায় ত্রাণ কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। নেত্রীর নির্দেশ মোতাবেক আমি চেয়ারম্যান হিসেবে আমার দ্বায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি।এই বিষয়ে জানতে চাইলে বর্তমান সাংসদের অনুসারী বীরগাঁও ইউপি আওয়ামী লীগের সভাপতি হোসেন সরকার বলেন, এখানে আমাদের কোন হাত নেই। কবির চেয়ারম্যান দুই তিন বছর আগে নিজেই একটি মিটিংয়ে বলেছেন, তিনি কৃষ্ণনগরের ওই ঘটনার একপক্ষের দলনেতা কাউসার মোল্লার পক্ষের লোক। এই মামলার বিষয়ে আমাদের কোন হাত নেই।

এদিকে, এই হত্যাকান্ডের ঘটনার পর কাউসার মোল্লা পক্ষের লোকজনে বাড়িঘর পুরুষ শুন্য হয়ে পড়েছে। এই সুযোগে তাদের বাড়িতে এসে জিল্লুর রহমানের লোকজন হুমকি দামকি দিয়ে যাচ্ছেন। এমন কি লুটপাট করতে আস্ত বিল্ডিং ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে ও আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে বসতঘর। বাড়িতে থাকা হেনা বেগম জানান, আমরা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে ছিলাম। শুধু ধান কাটার সময়ের কারণে আমরা ঝুঁকি নিয়ে থাকছি। দিনে দল বেধে এসে আমাদেরকে হুমকি দিচ্ছে, যেন নিজ বাড়ি ছেড়ে চলে যাই।

গ্রামের ভেতরেই কয়েকটি বাড়ি চোখে পড়ে আগুনে পুড়া ঘর। পাশাপাশি দুইটি বাড়ির বিল্ডিং হেমারের মাধ্যমে ঘুরিয়ে দেওয়া ধ্বংসস্তুপ। এসময় হাজেরা বেগম নামের এক নারী বলেন, এই পাকা ভবন মালিক বজলু মিয়া। পা কেটে নেওয়া মোবারক মারা যাওয়ার একটি পর মধ্যরাতে জিল্লুর চেয়ারম্যানের লোকজন বড় বড় হেমার দিয়ে বিল্ডিংটি ভেঙে ফেলে। তারপর ভেতরে থাকা প্রায় ৫ লাখ টাকার মালামাল লুটপাট করে নিয়ে যায়। এই বাড়ির মালিক এখন এলাকা ছাড়া। এসব বিষয়ে নবীনগর থানা পুলিশে একচোখা ভুমিকা লক্ষ্য করা গেছে।প্রতিপক্ষের বাড়ীতে হামলা,ভাংচূও,অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনায় থানায় অভিযোগ নিয়ে গেলে পুলিশ রহস্যজনক কারণে তা গ্রহন করেনি। আর এই দুই ইউনিয়নের বাসিন্দাদের দাবি এই রাজনৈতিক খেলা থেকে মুক্তি চায় তারা। যেন এর বলি পাঠা নিরিহ কাউকে না করা হয়।

এব্যাপারে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (নবীনগর সার্কেল) মকবুল হোসেন বলেন, তদন্তে এজাহারভুক্ত সম্পৃক্ততা না পাওয়া গেলে, কাউকেই ন্যূনতম হয়রানি করা হবে না। তিনি আরো জানান, এর মধ্যে ২ নম্বর আসামিসহ এ মামলার এজাহারভুক্ত ৯ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের ধরতে অভিযান চলছে।

জহির সিকদার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
নিউজ ডেস্ক ।। বিডি টাইম্‌স নিউজ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে