প্রায় ১২শ’ বছরের পুরনো ব্রিটিশ রাজপরিবারের ইতিহাস। ইংলিশ স্যাক্সন বংশের প্রথম রাজা আলফ্রেড দ্য গ্রেট সূত্রপাত হয় বৃটিশ শাসনামলের। এটি ছিল ৮৭১-৮৯৯ খ্রিস্টাব্দ। তারপর ব্রিটেনের রাজসিংহাসনে অনেক রাজা-রানীর, অনেক রাজবংশের আবির্ভাব হয়েছে, যারা প্রায় সবাই ইংলিশ স্যাক্সন বংশের তথা প্রথম রাজা আলফ্রেড দ্য গ্রেটের স্যাক্সন বংশের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত ছিলেন। রাজা আলফ্রেড দ্য গ্রেটের পরে বর্তমান রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ পর্যন্ত ৩২ জন রাজা ও রানী ব্রিটিশ রাজসিংহাসন অলঙ্কৃত করেছেন। তবে রানী ভিক্টোরিয়ার সময়ই ব্রিটিশ সাম্রাজ্য সবচেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করে।
পরবর্তীতে ব্রিটিশ রাজা ষষ্ঠ জর্জ এবং তার মেয়ে দ্বিতীয় এলিজাবেথের সময় তা কমতে থাকে। তখন অবশ্য প্রায় পুরো পৃথিবীতেই সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা চলছিল। তারপরও লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার শহরের বাকিংহাম প্যালেস ব্রিটেনের রাজতন্ত্র ও রাজকীয় আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে এখনো স্বমহিমায় উজ্জ্বল। বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত, অন্যতম বিলাসবহুল এবং গুরুত্বপূর্ণ এই ভবনে যুক্তরাজ্যের যে কোনো জাতীয় আনন্দ উৎসব এবং বিপরীতক্রমে সংকটময় পরিস্থিতিতে মানুষের সমাবেশস্থলে পরিণত হয় এই প্রাসাদ। বর্তমানে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ এই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক ও মধ্যমনি। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র প্রিন্স চার্লস হবেন পরবর্তী রাজশাসক। এটা মোটামুটি সবারই জানা। এ সময় প্রিন্স চার্লসের উপাধি পরিবর্তন হবে। কিছুদিন আগে রাজমুকুট চার্লসকে না দিয়ে প্রিন্স উইলিয়ামকে দেওয়া হবে বলে একটা গুজব উঠেছিল। কিন্তু প্রিন্স উইলিয়াম নিজের মুখেই সেটা উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, এরকম কিছু হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। বরং রানীর তিরোধানের পর উইলিয়াম হবে প্রিন্স অব ওয়েলস। চার্লসের বর্তমান উপাধি। প্রিন্স চার্লসের বর্তমান বয়স ৬৮ হওয়ার আগে তিনি পাচ্ছেন না।
প্রিন্স চার্লসের পর পরবর্তী উত্তরাধিকার হবেন প্রিন্স উইলিয়াম। তিনিও একই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাবেন। তারপর ব্রিটেন সাম্রাজ্যের সম্ভাব্য সম্রাট হতে পারেন প্রিন্স জর্জ। যে প্রিন্স উইলিয়ামের প্রথম ছেলে। তার অবর্তমানে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য আবারও একজন রানী পেতে পারে প্রিন্সেস শার্লটের মাধ্যমে। আর এই দুইজনের অবর্তমানে সাম্রাজ্যের মুকুট যেতে পারে প্রিন্স উইলিয়ামের ছোট ছেলে প্রিন্স লুইয়ের কাছে। এরপরই আসছে প্রিন্স হ্যারি ও মেগান মার্কেলের সন্তান প্রিন্স আর্চি। তাত্ত্বিকভাবে হ্যারি মেগানের সন্তান ব্রিটিশ সিংহাসনের সপ্তম উত্তরাধিকারী। উত্তরাধিকারসূত্রেই বাবার পরেই আছে সে।
এদিকে, সম্প্রতি ব্রিটিশ রাজপরিবার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন প্রিন্স হ্যারি ও তার স্ত্রী মেগান মার্কেল। এক বিবৃতিতে তারা জানান, রাজপরিবার থেকে বেরিয়ে স্বাধীন জীবনযাপন করতে চান। রাজ পরিবার থেকে অর্থ গ্রহণ করবেন না বলেও জানান তারা। এর বদলে নিজেরা আর্থিকভাবে স্বাধীন হওয়ার জন্য কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এই দম্পতি। এছাড়া তাদের শিশু সন্তান নিয়ে জীবন যাপনে জন্য বৃটেন ও উত্তর আমেরিকায় ভাগাভাগি করে সময় কাটাতে চান বলে জানিয়েছেন তারা। জানান, বেশ কয়েক মাস ধরে আলোচনা ও চিন্তার পর এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। আচমকা এমন সিদ্ধান্তে হতবাক রানীসহ রাজপরিবারের সবাই। কেননা আগে থেকে কেউই এমন সিদ্ধান্তের কথা জানতেননা। ফলে রাজ পরিবারের অন্য জ্যেষ্ঠ সদস্যরাও আহত হন ওই ঘোষণায়। আর এ নিয়েই রাজপরিবারে দেখা দিয়েছে তীব্র সংকট। এমন সিদ্ধান্তের কথা জানানোর পরই কানাডায় ফিরে যান মার্কেল।
বুধবার প্রিন্স হ্যারি ও মেগানের বিবৃতির পর রাজপ্রাসাদ থেকে একটি বিবৃতি দেয়া হয়। তাতে বলা হয়, তাদের ভিন্ন পথ বেছে নেয়ার উদ্যোগটি তারা বিবেচনায় নিয়েছেন। কিন্তু এসব খুব জটিল বিষয়। সমাধান করতে বেশ সময় লাগবে। বাকিংহাম প্যালেস আরো জানায়, রাজপরিবার থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও বর্তমানে প্রিন্স হ্যারি রাজসিংহাসনের ৬ষ্ঠতম দাবিদারই থাকবেন। তবে আচমকা উদ্ভূত এ সংকটের সমাধান করতে এখন আলোচনা চলছে রাজপরিবারে। খবরে বলা হয়, ব্রিটিশ রাজপরিবারে মেগানের ভবিষ্যত ভূমিকা নিয়ে আলোচনা চলছে। রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, প্রিন্স অব ওয়েলস ও ডিউক অব ক্যামব্রিজ চলমান সংকট সমাধানে কাজ করছেন। তবে প্রশ্ন হলো হঠাৎ কেনো এমন সিদ্ধান্তে আসলেন তারা। বলা হচ্ছে, গণমাধ্যমের অতিরিক্ত নজরদারি, রাজপরিবারের নিয়মকানুন আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। গেল অক্টোবরেই হ্যারি ও মেগান জানিয়েছিলেন, রাজ পরিবারের সদস্য হিসেবে সারাক্ষণ গণমাধ্যমের নজরে থাকতে হয় বলে ব্যক্তিগত জীবন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এর তিন মাসের মাথায় তারা নিজেদের ইনস্টাগ্রামে রাজ পরিবার ছাড়ার ঘোষণা দিলেন। ঘোষণায় ব্রিটিশ রাজপরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যের দায়িত্ব থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়ার কথাও বলেছেন তারা।
গণমাধ্যমের খবরে আরো বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক অভিনেত্রী মেগান তার কাজের সূত্রে এক সময় টরন্টোতে কাটিয়েছেন। তবে প্রিন্স হ্যারির সঙ্গে বিয়ের পর রাজ পরিবারের জীবনে অনেক কিছুর সঙ্গেই তারা মানিয়ে নিতে পারছেন না তিনি। তিনি বলেছেন, বোবা পুতুল হয়ে তিনি থাকতে চান না। কিন্তু যখনই সোচ্চার হয়েছেন, তাকে সমালোচনার মূখে পড়তে হয়েছে। এমনকি মিডিয়ার ক্যামেরা আর রাজ পরিবারের গুরুগম্ভীর আচার-অনুষ্ঠানগুলো হ্যারি ও মেগানের অপছন্দ। অবশ্য তারাই প্রথম নন, হ্যারির মা প্রিন্সেস ডায়ানাও প্রিন্স চার্লসের সঙ্গে বিচ্ছেদের আগে ১৯৯৩ সালে রাজকীয় দায়িত্ব কমিয়ে নিজের মত জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তার আগে ১৯৩৬ সালে রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড তো মার্কিন নারী ওয়েলিস সিম্পসনকে বিয়ে করার জন্য সিংহাসনই ত্যাগ করেছিলেন। এছাড়া হ্যারির চাচা প্রিন্স অ্যান্ড্রু গতবছর শেষ দিকে এপস্টেইন কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে রাজকীয় দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেন। আর অ্যান্ড্রুর সাবেক স্ত্রী সারাও তাদের বিচ্ছেদের পর রাজকীয় দায়িত্ব থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন।
এছাড়াও রাজপদবি ত্যাগের ঘটনাও বিরল নয় ব্রিটিশ রাজপরিবারে। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মেয়ে প্রিন্সেস অ্যানিকে যখন তাঁর সন্তান পিটার ও জারার জন্য যখন রাজকীয় উপাধি দেয়া হয, তখন তিনি তা ফিরিয়ে দেন। কারণ হিসেবে জানা যায়, রাজপরিবারের পদবি বা উপাধি ধারণ করলে অনেক নিয়ম মেনে বড় হতে হয়। কিন্তু সন্তানদের যতটা সম্ভব স্বাভাবিক জীবন-যাপনে বড়ো করতে চান তিনি। এদিকে, বিবিসির একজন সাংবাদিক লিখেছেন, হ্যারি-মেগানের এই ঘোষণা বাকিংহাম প্রসাদকে বেশ বড় ধাক্কা দিয়েছে। তবে সোমবার বিষয়টি সমাধানে রাজপরিবারের জ্যৈষ্ঠ সদস্যদের সঙ্গে জরুরী বৈঠকের ডাক দেন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেধ। এই বৈঠকেই কোনো সমাধান আসতে পারে বলে আশা করা করছে সবাই।
নিউজ ডেস্ক ।। বিডি টাইম্স নিউজ