বাংলাদেশে ভোগ্যপণ্যে ভেজাল চরম আকার ধারণ করেছে৷ তবে শুধু ভোগ্যপণ্য নয়, শিশু খাদ্য, প্রসাধন সামগ্রী, এমনকি জীবন রক্ষাকারী ওষুধেও ভেজাল৷ প্রতিবছর প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ খাদ্যে বিষক্রিয়ার কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে৷ খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণের নামে সেসব রাষায়নিক ব্যবহার করা হয়, কৃষিতে যেসব কীটনাশক ব্যবহার করা হয় যা খাবারকে বিষাক্ত করে তুলছে৷ তাই বাংলাদেশের মানুষেরগড় আয়ু বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা ধরণের রোগও বাড়ছে৷
জাতীয় জনস্বাস্থ্য ইন্সটিউট নামে বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠান বাজার থেকে ভোগ্যপন্য পরীক্ষার জন্য দৈব চয়নের ভিত্তিতে সংগ্রহ করে৷ ভোগ্যপণ্যে কী পরিমান ভেজাল আছে তা দেখতে তারা প্রতিবছরই এই পরীক্ষা করে৷ গত বছর সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটি সারাদেশ থেকে ৪৩টি ভোগ্যপণ্যের মোট ৫ হাজার ৩৯৬টি নমুনা পরীক্ষা করে ৷ আর বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, তাদের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে খাবারের তালিকাভুক্ত ৪৩ ধরনের পণ্যেই ভেজাল পাওয়া গেছে৷ ভেজালের পরিমাণ গড়ে শতকরা ৪০ ভাগ৷ এর মধ্যে ১৩টি পণ্যে ভেজালের হার প্রায় শতভাগ৷
আর তাদের পরীক্ষায় দেখা গেছে নিত্যদিনের রান্নায় ব্যবহৃত সয়াবিন তেল আছে ভেজালের শীর্ষে৷ সয়াবিন তেলে ফলিক অ্যাসিড পাওয়া গেছে শতকরা দুই দশমিক আট ভাগ৷ আর ফলিক অ্যাসিডের সহনীয় মাত্রা হচ্ছে শতকরা দুই ভাগ৷ ফলিক অ্যাসিডসহ অন্য সব মিলে সয়াবিনে ভেজালের মাত্রা হলো শতকরা ৭৮ ভাগ৷ এছাড়া সরিষার তেলে ৫৬ ভাগ, পাম অয়েলে ৩২ ভাগ, নারিকেল তেলে ২৫ ভাগ ভেজাল৷ বাকি পণ্যগুলোতে জিরার গুঁড়ায় ১৮ শতাংশ, মরিচের গুঁড়ায় ৬০ ভাগ, হলুদ গুঁড়ায় ৩১ এবং ধনিয়ার গুঁড়ায় ৫৩ ভাগ ভেজাল চিহ্নিত হয়েছে৷
আটায় শতকরা ভেজালের পরিমাণ শতকরা ১১ ভাগ, ময়দায় ৯ ভাগ, সুজিতে ২৭ ভাগ, বিস্কুটে ৪৬ ভাগ, বেসনে ৫২ ভাগ এবং সেমাইয়ে ৮২ ভাগ৷ অন্যদিকে চিনিতে শতকরা ৫, লবণে শতকরা ৩৬, চা পাতায় শতকরা ১০, আখের গুড়ে শতকরা ৫৭, খেজুরের গুড়ে শতকরা ২৫, মুগ ডালে শতকরা ৯, চাটনিতে শতকরা ৮৩ এবং কেকে শতকরা ৭০ ভাগ ভেজাল চিহ্নিত করা হয়েছে৷
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ৫১টি ভোগ্যপণ্যের ৬৪০টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়৷ এর মধ্যে ৩০টি পণ্যের ১৮৩টি নমুনার মধ্যে ভেজাল পাওয়া গেছে৷ তাদের ল্যাবে আসা মিষ্টির ৩২টি নমুনার সব কটিতেই পাওয়া গেছে ভেজাল৷ জনস্বাস্থ্য ইন্সটিউটের সংশ্লিষ্ট পরীক্ষাগারে দেখা গেছে, তেলের রং কখনো স্বচ্ছ বা গাঢ় করা অথবা ঝাঁজ বাড়ানোর জন্য বিশেষ ধরণের রং ও রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়ে থাকে৷ আবার হলুদ-মরিচের গুঁড়ায় কাঠ ও ইটের গুঁড়া জাতীয় উপাদান মেশানো হয়৷ মিষ্টিতে যেসব রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় সেগুলোর সবই স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর।
ইন্সটিউট ল্যাবের অ্যানালিস্ট আব্দুর রব ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘পরীক্ষায় আমরা দেখতে পাচ্ছি কঠোর আইনের পরও ভেজাল কমছেনা৷ বরং দিন দিন ভেজাল বাড়ছে৷ এটা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে ভেজালমুক্ত খাবার পওয়াই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে৷” তিনি জানান, ‘‘ভেজালের শীর্ষে আছে মিষ্টি ও ভোজ্য তেল৷ তেল ,ঘি, গুঁড়া মরিচ , হলুদ এসবে ভেজাল ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে৷ শিশুরা যে জুস পান করে তা ক্ষতিকর রাসায়নিকে পরিপূর্ণ৷ আমরা চায়ের সঙ্গে যে কন্ডেন্সড মিল্ক ব্যবহার করি তাতে দুধের লেশ মাত্র নেই৷”
ওষুধে ভেজাল
চলতি বছরেই বাণ্যিজ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ভেজাল ওষুধ উত্পাদনের অভিযোগে ২০টি জীবন রক্ষাকারী ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করেছে৷ এছাড়া তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে ১৪টি কম্পানির সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক উত্পাদনের অনুমতি বাতিল, ২২টি কম্পানির পেনিসিলিন ও সেফালোস্পোরিন গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক উত্পাদনের অনুমতি স্থগিত করার সুপারিশ করা হয়৷ মাঝেমধ্যে ব্যবস্থা নিলেও এসব তত্পরতা বন্ধ হয়না৷
আইন ও আদালত
বাংলাদেশে এখন ‘নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩’ কার্যকর রয়েছে৷ এই আইনে খাদ্যদ্রব্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক মেশানোর শাস্তি হিসেবে ৭ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে৷ আইনে প্রথমবার কেউ এ অপরাধ করলে সাত বছর এবং দ্বিতীয়বার ধরা পরড়লে ১৪ বছরের কারাদন্ডের বিধান আছে৷ আছে ২০ লাখ টাকা জরিমানা৷
খাদ্য মন্ত্রণালয় নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা এবং ‘বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত’ চালুর পদক্ষেপ নিয়েছে৷ ইতিমধ্যে গঠন করা হয়েছে ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর৷ অধিদপ্তর তিন বছরে ২৫১ জন অভিযোগকারীর অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পর দায়ীদের জরিমানা করেছে৷
জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ খাদ্যে বিষক্রিয়ার ফলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে৷ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক গবেষণায় লিভার ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার জন্য বিষযুক্ত খাদ্যকে দায়ী করা হচ্ছে ৷