পৃথিবীতে একমাত্র বাঙালী জাতিই মাতৃভাষার জন্য আত্মদান দিয়েছে। ৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামের মূলভিত ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রচিত হয়েছিল। ২১ ফেব্রুয়ারী শুধু আমাদের বাঙালীর অহংকার নয়, এখন সাড়া বিশ্বের অধিকার আদায়ের পথ প্রদর্শকও। যা ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতি পেয়েছে ১৯৯৯ সালে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইলের বীরত্বগাথা ইতিহাস মতোই ৫২ এর ভাষা আন্দোলনেও রয়েছে গৌরবময় ভূমিকা। টাঙ্গাইলের অনেক বীর সন্তান ভাষা আন্দোলনে জাতীয়ভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। মরহুম মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এছাড়া আবদুল মান্নান (প্রয়াত), ড. মফিজ উদ্দিন আহমদ (প্রয়াত), ডা. মির্জা মাজহারুল ইসলাম (জীবিত), বেগম ফজিলাতুন্নেছা (প্রয়াত), সোফিয়া খান (প্রয়াত), সাইয়িদ আতিকুল্লাহ (প্রয়াত) ও আব্দুস সালাম (প্রয়াত) উল্লেখযোগ্য। ১৯৫২ সালের ২২’শে ফেব্রুয়ারী রাতে সরকারের হুলিয়া মাথায় নিয়ে তৎকালীন রমেশ হলের নিকটে (বর্তমানে সাধারণ পাঠাগারের পশ্চিমপাশে) টাঙ্গাইলে সর্বপ্রথম শহীদ মিনার স্থাপন করা হয়।
ভাষা আন্দোলনে টাঙ্গাইলের গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকলেও জেলার ২৫৬১ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৮৮২ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই নেই শহীদ মিনার। এতে দেশপ্রেম ও বাঙ্গালির চেতনাবোধ প্রশ্নবিদ্ধ বলে মন্তব্য করেছেন ভাষা সৈনিকসহ অনেকেই।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলার ১৬২৩টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ১৩২৯টিতেই শহীদ মিনার নেই। এরমধ্যে ঘাটাইলের ১৭৩টির মধ্যে ১৪টিতে, সখিপুরে ১৪৭টির মধ্যে ৭৬টিতে, গোপালপুরে ১৫৯টির মধ্যে ৮টিতে, বাসাইলে ৭৯টির মধ্যে ৮টিতে, টাঙ্গাইল সদরের ১৬৪টির মধ্যে ১৭টিতে, দেলদুয়ারের ১০০টির মধ্যে ৮টিতে, মির্জাপুরে ১৭০টির মধ্যে ৪৫টিতে, কালিহাতীর ১৭০টির মধ্যে ৩০টিতে, মধুপুরে ১১০টির মধ্যে ২৮টিতে, নাগরপুরে ১৫৬টির মধ্যে ১৫টিতে, ভূঞাপুরে ১১০টির মধ্যে ২১টিতে এবং ধনবাড়ীর ৮৫টির মধ্যে ২৪টিতে মোট ২৯৪টি বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার রয়েছে।
এ বিষয়ে টাঙ্গাইল জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল আজিজ বলেন, বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নির্মাণের জন্যে সরকারিভাবে বরাদ্দ থাকে না। তবুও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় উদ্যোগে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারী থেকে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত সারা জেলায় ১৬১টি বিদ্যালয়ে নতুন শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। এরমধ্যে শুধুমাত্র সখিপুর উপজেলায়ই ৭০টি নতুন শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। জেলা শিক্ষা অফিসের অধীনে ৯৩৮টি হাইস্কুল, কলেজ, কারিগরি, এবতেদায়ী ও মাদ্রাসা রয়েছে। এরমধ্যে ৫৫৩টি প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নেই।
অফিস সূত্রে জানা যায়, টাঙ্গাইল সদরের ১০৪টির মধ্যে ১৭টিতে, বাসাইলের ৪২টির মধ্যে ১৫টিতে, কালিহাতীর ৮৭টির মধ্যে ৫২টিতে, সখিপুরের ১০১টির মধ্যে ২৭টিতে, ঘাটাইলের ১১৫টির মধ্যে ৩৮টিতে, গোপালপুরের ৮৪টির মধ্যে ৪৩টিতে, মধুপুরের ৭৭টির মধ্যে ৩২টিতে, ধনবাড়ীর ৬৬টির মধ্যে ২৬টিতে, মির্জাপুরের ৭৬টির মধ্যে ৫০টিতে, দেলদুয়ারের ৩৮টির মধ্যে ২৩টিতে, নাগরপুরের ৭৭টির মধ্যে ৩৭টিতে ও ভূঞাপুরের ৭১টির মধ্যে ২৫টিতে মোট ৩৮৫টি প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার রয়েছে। এ বিষয়ে একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষা সৈনিক টাঙ্গাইলের কৃতি সন্তান ডাঃ মির্জা মাজহারুল ইসলাম (৯৩) বলেন, ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সমৃদ্ধ দেশের অন্যতম স্থান টাঙ্গাইল। জেলার এতোগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার কেন নেই? এটা অত্যন্ত লজ্জার ও হতাশাজনক। এতে আমাদের দেশপ্রেম ও বাঙালীর চেতনাবোধ প্রশ্নবিদ্ধ।
জেলা প্রশাসক শহীদুল ইসলাম বলেন, শহীদ মিনার আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং বাঙ্গালী চেতনার অংশ। প্রতিটি শিক্ষার্থীদের মনে মাতৃভাষার সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার জন্য মাদ্রাসাসহ প্রতিটি বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার থাকা উচিত। জেলায় এতোগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নেই, এর সঠিক তথ্য আমাদের কাছে ছিল না। শহীদ মিনার নির্মাণে আমরা বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অনুপ্রাণিত করবো। প্রয়োজনে আর্থিক সাহায্য দেয়া হবে। সেই সাথে স্থানীয়ভাবে বিত্তবানদের এগিয়ে আসতে হবে।
কে এম মিঠু
টাঙ্গাইল নিউজ ডেস্ক ।। বিডি টাইম্স নিউজ