বিগত দুই যুগ ধরে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ অ্যানালগ কেবল টিভি দেখে আসছে। এই মুহূর্তে দুই জন প্রধান বিতরণকারী সংস্থা এবং প্রায় এক হাজারের বেশী বৈধ কেবল টিভি অপারেটর দেশের সর্বত্র ১৬ কোটি মানুষের দোরগোড়ায় এই কেবল টিভি সেবা পৌঁছে দিচ্ছে। এদের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে সারাদেশে আজ আনুমানিক দুই কোটি টেলিভিশন কেবল টিভি সংযোগ এর আওতাভুক্ত রয়েছে। বলাই বাহুল্য যে এই অ্যানালগ কেবল টিভির মাধ্যমে দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে ৮০ হতে ৯০টি টিভি চ্যানেল প্রদর্শনের সামর্থ্য থাকলেও জিলা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে এই সংখ্যা কমে নিম্নে ২৫ হতে ৪০টি টিভি চ্যানেল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। এর ফলে অনেক জরুরী সংবাদ ও দেশী টিভি চ্যানেল গ্রাহকদের দোরগোড়ায় পৌঁছানো সম্ভব হয় না। এর মূল কারণ হিসাবে অ্যানালগ কেবল টিভি ভিত্তিক বিতরণ ব্যাবস্থার প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতাকে চিহ্নিত করা যেতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় এসে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষে প্রযুক্তিখাতকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছেন। এর ফলে আজ সারাদেশের মানুষের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছানোর পাশাপাশি বিভিন্ন প্রযুক্তিগত সেবার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। জাতিসংঘের মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এম ডি জি) অর্জনে এবং সাম্প্রতিককালে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনের ফলে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হতে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের টেলিযোগাযোগ শিল্পের বিকাশ বিশেষভাবে প্রশংসিত হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের কেবল টিভি বিতরণ ব্যবস্থার তেমন কোন উন্নয়ন করা হয়নি। অ্যানালগ কেবল টিভি বিতরণ পদ্ধতিতে ছবি ও সিগন্যালের মান খুবই নিম্নমানের হয়ে থাকে যার মূল কারণ হল আমাদের কেবল টিভির তার, তারের কানেক্টর, স্প্লিটার এবং আমপ্লিফাইয়ার। অ্যানালগ পদ্ধতিতে কেবল টিভির তারের ভিতর দিয়ে এক গিগাহার্জ তরঙ্গ ব্যাবহার করে সর্বোচ্চ ১০৬ টি চ্যানেল বিতরণ সম্ভব থাকলেও বাস্তবে তা ৯০ হতে ৯৬ টির বেশী নয়। তাছাড়া এই পদ্ধতিতে কিছু উচ্চ তরঙ্গ বিশিষ্ট চ্যানেল ধারণ করা সম্ভব হয়না যার ফলে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতার তুলনায় অনেক কম চ্যানেল পরিবেশন করা হয়। অ্যানালগ কেবল টিভি বিতরণ ব্যবস্থা ২০ বছর আগের প্রযুক্তি যার পরিবর্তে বিশ্বব্যাপী এখন ডিজিটাল বিতরণ ব্যবস্থা প্রতীয়মান। এ মুহূর্তে সারাদেশে আনুমানিক দুই কোটি টিভি সংযোগ থাকলেও বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব আয় হয় প্রায় ১০ কোটি টাকা যা সম্মিলিত সংযোগের শতকরা ১% আয়। এই অঙ্কের শতকরা ৪০% জোগান দেয় মাত্র দুই জন প্রধান বিতরণকারী সংস্থা এবং বাকি ৬০% আসে অন্য এক হাজারের ও বেশী ছোট বড় কেবল টিভি অপারেটরদের কাছ থেকে। প্রচলিত অ্যানালগ প্রযুক্তি হতে উন্নত ডিজিটাল কেবল টিভি প্রযুক্তির প্রবর্তন ঘটলে শতকরা ১৫% হারে এই খাত থেকে বছরে আনুমানিক ১,০৮০ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহ সম্ভব।
ডিজিটাল কেবল টিভি প্রযুক্তির কিছু সুবিধা
১। অ্যানালগ কেবল টিভি প্রযুক্তির তুলনায় ডিজিটাল কেবল টিভি প্রযুক্তিতে দেখা ছবি ও শব্দের মান অত্যন্ত পরিষ্কার ও স্পষ্ট।
২। ডিজিটাল প্রযুক্তির ফলে ছবির সিগন্যালের সর্বচ্চ গুণগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব যার ফলে হয় ছবি আসবে নাহলে ছবি আসবে না, কিন্তু ছবির মান খারাপ হবার কোন সম্ভাবনা থাকবে না।
৩। কেবল টিভি অপারেটরদের বিদেশী চ্যানেল সিগন্যাল পাইরেসির ফলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে, ডিজিটাল কেবল টিভি প্রযুক্তি সংযোজনের ফলে পাইরেসি বন্ধ করা সম্ভব।
৪। ডিজিটাল কেবল টিভির প্রযুক্তির মাধ্যমে সরকার সকল গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে পারবে, যা টেলিযোগাযোগ খাতে প্রতীয়মান।
৫। সরকার কেবল টিভি খাতের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারবে এই ডিজিটাল প্রযুক্তির দ্বারা।
৬। এই ডিজিটাল কেবল টিভি প্রযুক্তির ফলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে সকল চ্যানেলের সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ সম্ভব।
৭। যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে সকল টিভি চ্যানেলব্যাপী জরুরী তথ্য সম্প্রচার করা সম্ভব।
৮। বিদেশী টিভি চ্যানেল ডাউন-লিঙ্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের একটি নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি আরোপ করা সম্ভব।
৯। জাতিয় সম্প্রচার নিতিমালার পূর্ণাঙ্গ জোরদারকরন সম্ভব।
১০। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত সহ এর পাশাপাশি সিঙ্গাপুর, হংকং, পাকিস্তান, দুবাই ও পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশে ডিজিটাল কেবল টিভি প্রযুক্তি সংযোজনের ফলে দেশের তথ্যপ্রযুক্তিগত ব্যবহারের আন্তর্জাতিক সূচক বাড়বে।
১১। কেবল টিভি ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের আরও স্বচ্ছতা যাচাই করা সম্ভব।
১২। বিদেশী টিভি চ্যানেলগুলোর পাশাপাশি আমাদের দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলোর সক্ষমতা ও স্বকীয়তা নিশ্চিতকরণ সম্ভব।
১৩। শিশু ও তরুণদের হাতের নাগাল থেকে অপ্রাপ্তবয়স্ক টিভি চ্যানেলগুলোর প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব যা পাশ্চাত্যের অপসংস্কৃতি হতে আমাদের তরুণ সমাজকে রক্ষা করবে।
১৪। শিশুদের মানসিক বিকাশের পাশাপাশি শিক্ষার হার বৃদ্ধির লক্ষে শিক্ষামূলক টিভি অনুষ্ঠান সম্প্রচার সম্ভব।
১৫। ডিজিটাল কেবল টিভি প্রযুক্তির মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে সমগ্র বাংলাদেশব্যাপী রাস্তার উপর ঝুলন্ত তারের পরিমাণ কমানো সম্ভব।
১৬। এলাকাভিত্তিক কেবল শিল্পকে ঘিরে সন্ত্রাসীমূলক কর্মকাণ্ড কমাতে অনেকাংশে সাহায্য করবে এই ডিজিটাল প্রযুক্তি। নিয়মতান্ত্রিকভাবে লাইসেন্সধারী ছোট ও বড় এলাকাভিত্তিক কেবল টিভি অপারেটরদের সুবিধা দেওয়ার সম্ভব।
১৭। তাছাড়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভিশন ২০২১ এর আদলে প্রযুক্তিগত আধুনিকতা নির্ভরশীল ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে ডিজিটাল কেবল টিভি নেটওয়ার্কের বিকল্প নেই।
ডিজিটাল কেবল টিভি নেটওয়ার্ক করতে কি কি দরকার?
ডিজিটাল কেবল টিভি প্রযুক্তি সংযোজনের জন্য প্রচলিত কেবল টিভি অপারেটরদের তাদের নেটওয়ার্কে কিছু এককালীন পরিবর্তন সাধন করতে হবে। এই এককালীন বিনিয়োগ ভবিষ্যৎ বান্ধব এবং তাদের প্রচলিত নেটওয়ার্ক অ্যানালগ থেকে সম্পূর্ণরূপে ডিজিটালে পরিবর্তন করতে সাহায্য করবে। এই সকল আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর অবকাঠামো বিস্তারের (deployment) মাধ্যমে লোকাল কেবল টিভি অপারেটরগণ একরাশ নতুন সেবা গ্রাহকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে পারবে।
ডিজিটাল কেবল টিভি নেটওয়ার্ক এর জন্য দরকার উচ্চ মানের “হেডএন্ড” যেখানে থাকবে বড় মাপের হাই গেইন স্যাটেলাইট অ্যান্টেনা যার সাথে এল এন বি ও ব্যান্ডপাস ফিল্টার, প্রফেশনাল আই আর ডি রিসিভার, এনকোডার, নেটওয়ার্ক সুইচ, কোআম, মনিটরিং সিস্টেম, সাবস্ক্রাইবার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম এবং কনডিশনাল অ্যাক্সেস সিস্টেম। স্যাটেলাইট হতে সুরক্ষিতভাবে তরঙ্গ নামাবার জন্য দরকার উঁচু মানের, বড় সাইজের হাই গেইন সম্পন্ন সি-ব্যান্ড স্যাটেলাইট অ্যান্টেনা যার সাথে এল এন বি ও ব্যান্ডপাস ফিল্টার থাকবে যা আমাদের নিরবিছিন্নভাবে চ্যানেলের তরঙ্গ নামাতে সাহায্য করবে। এই তরঙ্গ হতে নিখুঁত ছবি ও স্পষ্ট শব্দ গ্রহণের করবার জন্য দরকার প্রফেশনাল ইন্ট্রেগ্রেটেড রিসিভার অ্যান্ড ডিকোডের (আই আর ডি)। খোলা বাজারে পাওয়া কম দামি রিসিভারের ন্যায় এই প্রফেশনাল আই আর ডি রিসিভার বহু গুণে ভালো ছবি ও শব্দ উপস্থাপনে সক্ষম যার মূল কারণ হল এর ভিতরে থাকা উচ্চ মানসম্পন্ন ভিডিও প্রসেসর।
সকল চ্যানেলের ছবি ও শব্দ প্রফেশনাল আই আর ডি রিসিভার হতে আইপি নেটওয়ার্ক সুইচের মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে কোআম নামক একটি যন্ত্রের কাছে প্রেরণ করা হয় যা এই সকল চ্যানেলকে একত্রিত করে বিতরণ করতে সাহায্য করে। এছাড়া গ্রাহক নিয়ন্ত্রণে সাবস্ক্রাইবার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম দ্বারা গ্রাহকদের তথ্য সংরক্ষণ ও মাস শেষে বিল পরিশোধের পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং কনডিশনাল অ্যাক্সেস সিস্টেম দ্বারা গ্রাহকদের পছন্দ ও সীমাবদ্ধতা অনুযায়ী টিভি চ্যানেল বিতরণ করা সম্ভব। তাছাড়া কনডিশনাল অ্যাক্সেস সিস্টেমের মাধ্যমে গ্রাহকের সেট-টপ বক্সের চিপসেট সনাক্তকরণ সম্ভব যার ফলে সুরক্ষিত ও নিয়ন্ত্রিত উপায়ে তথ্য আদান-প্রদান করা যাবে। এই সকল প্রযুক্তিগত অবকাঠামো যেকোনো কেবল অপারেটরদের একটি মানসম্মত সেবা প্রদানে সাহায্য করবে। ডিজিটাল কেবল টিভি নেটওয়ার্ক কিভাবে করা সম্ভব? একটি ডিজিটাল কেবল টিভি নেটওয়ার্ক অপারেশন আরম্ভ দুটি বাস্তবমুখী ধাপে সম্ভব । প্রথম ধাপ হল একটি উন্নত “ডিজিটাল হেডএন্ড” তৈরি করা অথবা প্রচলিত উপায়ে একজন “ফীড অপারেটর” হিসেবে একটি সরকারকর্তৃক পরীক্ষিত ও অনুমোদিত উন্নত ডিজিটাল হেডএন্ড এর সাথে সংযুক্ত হয়ে নেটওয়ার্ক পরিচালনা করা। যেহেতু ডিজিটাল কেবল টিভি নেটওয়ার্ক অপারেশনের জন্য একটি ডিজিটাল হেডএন্ড থাকা বা এর সাথে সংযুক্ত থাকা অত্যাবশ্যক, তাই যেকোনো ব্যবসার মত এই প্রযুক্তির উপর এককালীন একটি বিনিয়োগ দরকার।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় হতে অনুমোদন পত্র গ্রহণের পর একজন কেবল অপারেটর বিশ্বমানের ডিজিটাল হেডএন্ড প্রযুক্তি সরবরাহকারি কোম্পানি হতে এই সকল প্রযুক্তি আমদানি করতে পারবে। আমদানির পর এই সকল যন্ত্রাংশ দ্বারা অপারেশন শুরুর পূর্বে সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের নিকট গুণগত মান যাচাই করে সরকার থেকে অনাপত্তিপত্র সংগ্রহ করবেন যাতে করে গ্রাহকের কাছে নিখুঁত ছবি ও শব্দ সম্প্রচার করা সম্ভব হয়। তা ছাড়া ফীড অপারেটর হিসাবে যেই সকল কেবল অপারেটর কাজ করতে ইচ্ছুক তাদের মাঠ পর্যায়ে কিছু তারের কানেক্টর, স্প্লিটার এবং আমপ্লিফাইয়ারে পরিবর্তন সাধন করা দরকার। এর ফলে কেবল অপারেটরগণ তাদের সাথে সংযুক্ত সকল গ্রাহকদের দোরগোড়ায় ডিজিটাল কেবল সার্ভিস পৌঁছে দিতে সক্ষম হবেন। সকল ফীড অপারেটর নিজ উদ্যোগে একজন ডিজিটাল হেডএন্ড অপারেটরের সাথে ফাইবার অপটিক তাঁরের মাধ্যমে সংযুক্ত হতে পারবেন। সকল ডিজিটাল কেবল অপারেটর এই ক্ষেত্রে তাদের নেটওয়ার্কে সম্প্রচারের পূর্বে ডিজিটাল সিগন্যাল পরীক্ষা নিরূপণ করে সম্প্রচার করতে পারবেন। যেহেতু কেবল টিভি হেডএন্ড অপারেটর হতে কিছু সুবিধা প্রদান করা সম্ভব যেমন গ্রাহক পর্যায়ে বিলিং, ফলে মাঠ পর্যায়ে ফীড অপারেটরগন সকল সংযুক্ত গ্রাহকের নির্ভুল হিসাব রাখতে পারবেন। এর ফলে সরকার যেকোনো সময় সাবস্ক্রাইবার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ও কনডিশনাল অ্যাক্সেস সিস্টেম হতে গ্রাহকের তথ্য সংরক্ষণ করতে পারবে এবং মাঠ পর্যায়ে ভালো পরিমাণ অঙ্কের রাজস্ব আদায় করতে পারবে।
ডিজিটাল কেবল টিভির অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট
এই মুহূর্তে কেবল টিভি খাত থেকে বাংলাদেশ সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব আদায় করে থাকে তার শতকরা ৪০% আসে দুজন মূল পরিবেশক হতে। বাকি শতকরা ৬০% আসে এক হাজারের ও বেশী ছোট বড় লাইসেন্সপ্রাপ্ত কেবল টিভি অপারেটর থেকে। বর্তমানে সরকার উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে রাজস্ব খাতে আদায়ের পরিমাণের দিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। এই অবস্থায় কেবল টিভি খাত থেকে উদ্বৃত্ত ১০ কোটি টাকার রাজস্ব পর্যায়ক্রমে কিছু বাস্তবমুখী ধাপে ১,০০০ (এক হাজার) কোটি টাকায় উন্নত করা সম্ভব। বর্তমানে কেবল টিভি গ্রাহকগন বিভাগীয় শহরে ৩০০ টাকা হতে ৫০০ টাকা পর্যন্ত মাসিক ফি পরিশোধ করে থাকেন, যা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ২০০ হতে ৩০০ টাকা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। এখানে গ্রাহকগন একটি টিভির ফি পরিশোধের বিপরীতে অনেক ক্ষেত্রে বহুবিধ টিভিতে সংযোগ স্থাপন করে থাকেন। কিন্তু এর পরিবর্তে কেবল টিভি অপারেটরগণ সরকারকে রাজস্বখাতে তেমন বেশী টাকা পরিশোধ করছেন না।
একটি জরিপে দেখা গেছে সারাদেশে আনুমানিক ২ (দুই) কোটি টেলিভিশন সচল আছে যার মধ্যে কেবল টিভি সংযোগ রয়েছে। এই সকল টিভি যদি সরকারের রাজস্ব খাতের আয়তায় আসত তাহলে সরকার মাসে কেবল টিভি অপারেটরদের থেকে আনুমানিক ৯০ কোটি টাকা মূল্য সংজোযন কর আদায় করতে পারতো যা বছরে ১,০৮০ কোটি টাকা পর্যন্ত সরকারি কোষাগারে জমা হতো। তা ছাড়া ডিজিটাল কেবল টিভির জন্য সেট টপ বক্স বিক্রি হতে সরকারের শুল্ক আয়ের সম্ভাবনা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাবে। বলাই বাহুল্য যে সরকারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এই খাত একটি উজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। তাছাড়া ডিজিটাল প্রযুক্তি নির্ভর সামাজিক অবকাঠামো নির্মাণে এই কার্যক্রম সরকারের রাজস্ব খাতকে আরও সুদৃঢ় করতে সাহায্য করবে এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের অবস্থান শক্তিশালী করে তুলবে।
ডিজিটাল কেবল টিভি পরিচালনায় সামাজিক ও নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা
ডিজিটাল কেবল টিভি সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সমন্বিত নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা অপরিহার্য। একটি নিয়ন্ত্রক হিসাবে সরকারের প্রয়োজন-
১। সরকারের ডিজিটাল কেবল টিভি সেবা নিয়ন্ত্রণের লক্ষে একটি “ডিজিটাল কেবল টিভি নীতিমালা” এখন একটি সময়ের দাবি।
২। উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির আদলে বিদেশী টিভি চ্যানেলের ডাউনলিঙ্কের পূর্বে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি গ্রহণ।
৩। সকল কেবল টিভি অপারেটরদের ও ফীড সম্প্রচার কার্যক্রম ও সম্প্রচারের মান পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষণ বেষ্টনীর আওতায় আনা।
৪। সকল কেবল টিভি ও ফীড অপারেটরদের গ্রাহক পর্যায়ে সকল তথ্য একটি আবেদনপত্রের (সাবস্ক্রাইবার আপ্লিকেশন ফর্ম) মাধ্যমে সংরক্ষণ করতে হবে।
৫। সকল কেবল টিভি ও ফীড অপারেটরদের মাসিক ভিত্তিতে একটি করে তথ্য বিবরণী দাখিল করতে হবে যেখানে তাদের গ্রাহক পর্যায়ে তথ্য থাকবে।
৬। ডিজিটাল কেবল টিভির মান নিয়ন্ত্রণের ও ভিডিও পাইরেসি প্রতিরোধের লক্ষে সরকারি ও বেসরকারি খাতের সমন্বিত একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কার্যনির্বাহী দল গঠন করতে হবে।
৭। একটি স্বাধীন নিয়ন্ত্রণ সংস্থা / কমিশন স্থাপন করা।
৮। বাংলাদেশ সরকারের ও বেসরকারি পর্যায়ে ফাইবার অপটিক কেবল ও ভূ-অবকাঠামো স্বল্পমূল্যে ব্যবহারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৯। ডিজিটাল কেবল টিভি অবকাঠামোর জন্য এককালীন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সহজ শর্তে ঋণ প্রদানে সহায়তা করা এবং দীর্ঘমেয়াদি আয়কর ছাড় প্রদান
১০। ডিজিটাল কেবল টিভি সেট টপ বক্স আমদানির ক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্ক কমিয়ে আনা।
পরিশেষে কিছু সুপারিশ
ডিজিটাল কেবল টিভি প্রযুক্তি একটি বর্তমান সময়ের চাহিদা। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির অঙ্গনে আমাদের প্রবেশের লক্ষে এই প্রযুক্তির জুরি নেই। এই প্রযুক্তির প্রচলন ও বিকাশে সরকারের আন্তরিক ও উন্মুক্ত সহযোগিতা একান্তভাবে কাম্য। এই বিবরণীর মাধ্যমে আমরা সরকারের কাছে ডিজিটাল কেবল টিভি প্রযুক্তির মাধ্যমে গ্রাহকের ও সরকারের তথা গোটা বাংলাদেশের আপামোর জনসাধারণের সার্বিক সেবার মান উন্নয়নের একটি বাস্তবসম্মত তথ্যচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রযুক্তির এই আশীর্বাদের সুফল মানসম্মতভাবে সকলের কাছে সহজলভ্য করতে সরকারের একটি বলিষ্ঠ নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা প্রত্যাশিত।
মিজানুর রহমান সোহেল
তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্লেষক, বিডি টাইম্স নিউজ