বিডিআর বিদ্রোহ ও পিলখানা হত্যাযজ্ঞের মতো ন্যক্কার জনক ঘটনা ঘটে সাবেক প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরপরই ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি। ওই ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়। দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন এ বিদ্রোহ এবং হত্যাযজ্ঞের পর হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে পৃথক মামলা করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে হত্যা মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন ২৪৮ জন। মামলার প্রক্রিয়া শেষ না হলেও হত্যা মামলায় দণ্ডিত ২৫৬ জনের সাজার মেয়াদও শেষ। অনেক আসামির জামিন আবেদন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে বিচারিক আদালতে।

সংবাদমাধ্যম আজকের পত্রিকার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এর মধ্যে হত্যা মামলায় বিচারিক আদালতে রায়ের পর হাইকোর্ট হয়ে তা চার বছর ধরে আপিল বিভাগে বিচারাধীন। তবে নিম্ন আদালতেই ঝুলে রয়েছে বিস্ফোরক মামলা। এই মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন বিডিআরের ৭ শতাধিক সদস্য। দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ও আসামি হয়ে কারাগারে থাকা অনেকে মুক্তি পেয়েছেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাই মুক্তির ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন অনেক বিডিআর সদস্য এবং তাদের স্বজনেরা। তবে রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবী না থাকায় তাদের জামিন আবেদনের শুনানি করা যাচ্ছে না।

আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিচারিক আদালত থেকে হত্যা মামলায় খালাস পাওয়া ২৭৮ জনের মধ্যে বর্তমানে খালাস অবস্থায় আছেন ২৪৮ জন। আর সাজার মেয়াদই শেষ হয়ে গেছে ২৫৬ জনের। শুধু বিস্ফোরক মামলার কারণে কারাগারে রয়েছেন ৫০৪ আসামি। হাইকোর্টে অন্তত ৪০টি জামিন আবেদন করা হয়েছিল; কিন্তু আমরা বিভিন্ন বেঞ্চে ঘুরছি। কোনো বেঞ্চেই শুনানি করতে পারিনি। একবার হাইকোর্ট এক আসামিকে জামিন দিলেও রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে আপিল বিভাগে তা স্থগিত হয়ে যায়।

আসামিপক্ষের আইনজীবীরা জানান, বিস্ফোরক মামলায় আসামি ছিলেন ৮৩৪ জন। এর মধ্যে পলাতক ২০ জন। বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর পর বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন ৭৮৭ জন। এখনো সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে মামলাটি। বিস্ফোরক মামলার বিচার শেষ না হওয়ায় অনেকে হত্যা মামলায় খালাস পেয়ে; কিংবা সাজার মেয়াদ শেষেও কারাগার থেকে মুক্তি পাননি। অনেকের অপরাধের ধরন এমন যে, দোষী সাব্যস্ত হলেও আইন অনুযায়ী ১৫ বছর সাজাও হবে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা নতুন করে তদন্ত ও বিচার এবং নির্দোষ সদস্যদের চাকরিতে পুনর্বহালের দাবি উঠেছে। চাকরিচ্যুত নিরপরাধ বিডিআর সদস্যদের বাহিনীতে পুনর্বহালের দাবিতে গত ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করেছে ৬৪ জেলার ‘ক্ষতিগ্রস্ত বিডিআর ঐক্য ২০০৯’।

সংবাদ সম্মেলনে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া এবং দ্রুত পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) নিয়োগ করে বিস্ফোরক মামলায় ১৫ বছর ধরে কারাগারে থাকা আসামিদের জামিনের দাবি জানানো হয়। এর কয়েকদিন আগে আরেক সংবাদ সম্মেলনে সাবেক ৫০ বিডিআরের সদস্য মামলার পুনঃ তদন্তের দাবি জানান।

আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, আসামিরা প্রায় ১৬ বছর কারাগারে আছেন। তাদের অনেকেই খালাস পাওয়ার উপযুক্ত। আমরা এরই মধ্যে জামিনের আবেদন করেছি। পিপি নিয়োগ হলেই সেগুলো শুনানি হবে। যেহেতু বিচার বিলম্বিত হচ্ছে, তাই জামিন না দেওয়াটা অবিচার। নতুন করে তদন্তের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অধিকতর তদন্ত হতে পারে। এ জন্য পুলিশকে আদালতে আবেদন করতে হবে। অধিকতর তদন্তে নতুন করে কারও সম্পৃক্ততা পেলে তার বিচার করতে আইনগতভাবে কোনো বাধা নেই। এ’নিয়ে জানতে চাইলে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) প্রেসিডেন্ট মনজিল মোরসেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিডিআর বিদ্রোহ ঘটনারও অধিকতর তদন্ত হতে পারে। তাতে কেউ নির্দোষ হলে তার মুক্তি ও নতুন কারও জড়িত থাকার প্রমাণ মিললে তাঁকে শাস্তির আওতায় আনা যাবে। তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) মইন ইউ আহমেদও নতুন তদন্তের পক্ষে। সম্প্রতি প্রচারিত এক আলোচিত ইউটিউব ভিডিওতে তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডটি নিয়ে ১৫ বছরে শুধু বিগত সরকারের কথা শুনতে হয়েছে। প্রকৃত ঘটনার অনেক কিছুই জানা নেই। মইন ইউ আহমেদ আশা প্রকাশ করেন, তদন্ত কমিটি পুনর্গঠিত করে ঘটনায় প্রকৃত জড়িত ব্যক্তিদের বের করা যাবে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান বলেন, দেড় দশকের বেশি সময় ধরে মামলার বিচারিক কার্যক্রম ঝুলে থাকা কাম্য নয়। এতে নানা কারণে ন্যায়বিচার লঙ্ঘন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মামলা নিষ্পত্তি হলে হয়তো এত দিনে অনেকে খালাসও পেতে পারতেন। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী না থাকার ফলে জামিন শুনানি করতে না পারার বিষয়টিও দুঃখজনক। বিনা অপরাধে দীর্ঘদিন আটক থাকা ব্যক্তি রাষ্ট্রের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারবেন বলেও মন্তব্য করেন শিহাব উদ্দিন খান। পিলখানা হত্যা মামলায় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর রায় দেন আদালত। তাতে ১৫২ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং ১৬১ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। সর্বোচ্চ ১০ বছরসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয় ২৫৬ জনকে। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পান ২৭৮ জন। বিদ্রোহের ঘটনায় বিচার করা হয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নিজস্ব আইনেও। এতে ১০ হাজার ৯৭৩ জনের বিভিন্ন ধরনের সাজা হয়। এর মধ্যে ৮ হাজার ৭৫৯ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এ ছাড়া সারা দেশে বিশেষ আদালত গঠন করে বিচার করা হয়।বিচারিক আদালতের রায়ের পর ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) শুনানির জন্য নথি পাঠানো হয় হাইকোর্টে। আর সাজার বিরুদ্ধে দণ্ডিত ব্যক্তিরা আপিল করেন। ৬৯ জনের খালাসের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি শেষে ২০১৭ সালের নভেম্বরে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় ১৮৫ জনের। এ ছাড়া ২২৮ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। আর বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডিত ২৮৩ জন খালাস পান।

হাইকোর্টের রায়ের পর সাজার বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করেন আসামিরা। অন্যদিকে হাইকোর্টে খালাস পাওয়া এবং সাজা কমা ৮৩ আসামির বিষয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। উভয় পক্ষের আবেদন এখন শুনানির অপেক্ষায়। এমন প্রেক্ষাপটে ঘটনার পর গঠিত সেনাবাহিনীর তদন্ত কমিটির দায়িত্বে থাকা বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পূর্ণ তদন্ত ও ন্যায়বিচার প্রক্রিয়া শিগগিরই শুরু করা হবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে