হোসাইন রুমেলঃ “বনের সংরক্ষণ অবশ্যই একটি জাতীয় অগ্রাধিকার হয়ে উঠতে হবে, এখনই আবাস্থল গুলো রক্ষা করার জন্য প্রদক্ষেপ না নিলে, আমরা শুধুমাত্র দুটি প্রজাতির হনুমানই হারাব না, আমরা বাংলাদেশের অমূল্য জীববৈচিত্র্যের একটি অংশও হারাব”-তানভীর আহমেদ । “এই গবেষণার ফলাফল একটি সতর্কবার্তা, এটি কেবল শুরু”- ড. ডিটমার জিনার
সিলেট বিভাগের বনাঞ্চলে বিশ্বব্যাপী বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা চশমাপরা হনুমান এবং মুখপোড়া হনুমানের মিশ্র প্রজাতির দল এবং সংকর সনাক্ত করা হয়েছে। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে, স্প্রিঞ্জার নেচারের International Journal of Primatology জার্নালে। প্রায় ৬ বছর ধরে চলা এই গবেষণার নেতৃত্ব দেন বিশ্ববিখ্যাত জার্মান প্রাইমেট সেন্টারের বাংলাদেশী পিএইচডি শিক্ষার্থী এবং আইইউসিএন প্রাইমেট বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য তানভীর আহমেদ।জার্মান প্রাইমেট সেন্টারের গবেষকবৃন্দ ছাড়াও ১৫ সদস্যের এই গবেষক দলে রয়েছেন সংযুক্ত আরব আমিরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সাবির বিন মুজাফফার, ইসাবেলা ফাউন্ডেশনের প্রধান গবেষক মোঃ সাবিত হাসান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী, স্থানীয় ইকো-গাইড এবং বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রী। বাংলাদেশ বন বিভাগের অনুমতিক্রমে মাঠ পর্যায়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয় ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত। তারপর, সংকর নিশ্চিতের জন্য গবেষণাগারে চলে হনুমানের মলের জীনগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আইইউসিএন লাল তালিকায় চশমাপরা হনুমান বিশ্বব্যাপী বিপন্ন এবং বাংলাদেশে মহাবিপন্ন তালিকাভুক্ত প্রাণী। এদের বিস্তৃতি কেবলমাত্র বাংলাদেশ থেকে ভারত হয়ে মায়ানমারের ইরাবতী নদী পর্যন্ত। মুখপোড়া হনুমান বিশ্বব্যাপী সংকটাপন্ন এবং বাংলাদেশে বিপন্ন তালিকাভুক্ত প্রাণী।
বাংলাদেশ ছাড়াও মুখপোড়া হনুমান ভারত, ভুটান, মায়ানমার এবং চীনের সামান্য কিছু অঞ্চলে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের সিলেট এবং চট্টগ্রাম বিভাগের বেশ কিছু পাহাড়ি বনে এই দুই হনুমান প্রজাতির বসবাস। এছাড়া মধুপুরের পত্রঝরা বনেও মুখপোড়া হনুমান আছে। তবে বাংলাদেশে তথা বিশ্বেই এই দুই প্রজাতির কি পরিমাণ হনুমান টিকে আছে তার স্পষ্ট তথ্য নেই। চশমাপরা হনুমানের একটি দলে সাধারণত ৪ থেকে ২৬ টি করে হনুমান থাকে আর মুখপোড়া হনুমানের দলে থাকে ৪ থেকে ১৭ টির মতো। উভয়েই মূলত বৃক্ষচারী প্রাণী এবং প্রয়োজনে মাটিতেও নামে। বন্য লতাপাতা, ফুল-ফল, কীটপতঙ্গ এদের প্রধান খাবার। এরা খাদ্য গ্রহণ ও মলের মাধ্যমে বিভিন্ন ফলের বীজ বনের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যা প্রাকৃতিকভাবে বনকে নতুন জীবন দান করে। গবেষণা সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৭-৯৮ সালে রেমা-কালেঙ্গা বনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মফিজুল কবির পিএইচডি গবেষণার সময় সর্বপ্রথম চশমাপরা হনুমান এবং মুখপোড়া হনুমানের দুইটি অস্থায়ী মিশ্র-প্রজাতির দল দেখেন। সেগুলোতে কোন সংকরেরও উপস্থিতি ছিল না। প্রায় ২০ বছর পরে, ২০১৭ সালে আমরা প্রথমবারের মতো সাতছরি জাতীয় উদ্যানে একটি সম্ভাব্য সংকর হনুমান দেখে বিস্মিত হয়। ইতিপূর্বে এই দুই প্রজাতির হনুমান মিলে সংকর হনুমান জন্মদানের কোন বৈজ্ঞানিক ইতিহাস নেই। মিশ্র-প্রজাতির হনুমান দল ও সংকরায়ন মাঠ পর্যায়ে গবেষণার প্রথম ধাপে হিসেবে গবেষকরা সিলেটের বিভাগের লাউয়াছড়া, সাতছড়ি, রেমা-কালেঙ্গা, রাজকান্ধি, পাথারিয়া এবং অতোরা সংরক্ষিত বনে মোট ৯২ দিন হনুমান জরিপ করেন। মিশ্র প্রজাতির হনুমানের দলগুলোকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখা হয় প্রায় ৪ বছর ধরে।
জরিপে মোট ৯৮টি হনুমানের দল দেখা যায়, যার মধ্যে ৪১টি ছিল চশমাপরা হনুমানের দল, ৪৯টি মুখপোড়া হনুমানের দল এবং বাকি ৮টি মিশ্র-প্রজাতির হনুমানের দল। গবেষকরা তিনটি মিশ্র দলে শারীরিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে তিনটি সম্ভাব্য সংকর হনুমানও চিহ্নিত করেন। যেগুলোর দুইটি দেখা যায় সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে এবং একটি রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে। সম্ভাব্য সংকরগুলোর মধ্যে প্রথম হনুমানটি ছিল পূর্ণবয়স্ক মহিলা, যার স্তনের আকার এবং লম্বাটে বোঁটার ধরণ থেকে সহজেই অনুমেয় যে তার বাচ্চাও ছিল এবং বাচ্চা নিয়মিত দুধ পান করত। বাকি দুটি সম্ভাব্য সংকর হনুমান অপ্রাপ্তবয়স্ক। তবে সংকরায়ন নিশ্চিত হওয়ার একমাত্র উপায় হল সম্ভাব্য সংকরের জীনগত পরীক্ষা করা। সংকরায়ন নিশ্চিতের জন্য সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান থেকে সংগৃহীত মলের নমুনার জীনগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় জার্মানির জার্মান প্রাইমেট সেন্টারের গবেষণাগারে। এতে গবেষণায় এক যুগান্তকারী তথ্য উঠে আসে- ২০২৩ সালে সাতছড়ির একটি মিশ্র দলে জন্মানো সম্ভাব্য সংকর হনুমানের বাবা আসলে চশমাপরা হনুমান এবং মা মুখপোড়া হনুমান। সংকর হনুমানের উপস্থিতি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক, কারণ এটি ইঙ্গিত দেয় যে এই দুই বিপন্ন প্রজাতির মধ্যে জেনেটিক প্রবাহ তাদের ভবিষ্যৎ জেনেটিক গঠনে অপরিবর্তনীয় প্রভাব ফেলতে পারে।
সংকরায়ন একটি বিরল কিন্তু প্রাকৃতিক ঘটনা, যা সাধারণত দুই প্রজাতির বিস্তৃতির মিলনস্থলে ঘটে। অনেক প্রজাতির প্রাণিতে এই ধরণের সংকর দেখা গেছে। সংকরায়ন প্রাণীর বিবর্তন প্রক্রিয়া এবং শ্রেণিবিন্যাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচিত বিষয়। তবে মানবসৃষ্ট নানা ক্রিয়াকলাপ যেমন বন ধ্বংস, বড় বন ছোট ছোট খণ্ডে ভাগ হওয়া, অবৈধ শিকার ও বাণিজ্যের কারণে প্রকৃতিতে প্রাণীর সংখ্যা কমে যাওয়া এবং নানা আগ্রাসী প্রজাতির মুক্তি বানর-হনুমান জাতীয় প্রাণীদের মধ্যে সংকরায়ন ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে এশিয়া মহাদেশের বেশী কিছু হনুমান প্রজাতিতে এ ধারা ক্রমবর্ধমানভাবে নথিভুক্ত হচ্ছে। জার্মান প্রাইমেট সেন্টারের সিনিয়র বিজ্ঞানী এবং লেখক অধ্যাপক ড. ক্রিস্টিয়ান রোস বলেন, “এটি কেবল একটি স্থানীয় সমস্যা নয় এটি একটি বৃহত্তর, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের অংশ। যখন আবাসস্থলগুলি ধ্বংস হয়ে যায়, প্রাণীরা এমনভাবে মিশ্রিত হয় যা প্রাকৃতিক ভাবে ঘটতো না, তার ফলস্বরূপ সেখানে সংকরায়ন ঘটতে পারে, এমনকি এক বা উভয় প্রজাতিকে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিতে পারে।” গবেষক তানভীর আহমেদ বলেন, গবেষণায় দেখা যায় লাউয়াছড়া ও সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান এবং রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে হনুমানের ঘনত্ব রাজকান্ধি, পাথারিয়া এবং অতোরা সংরক্ষিত বনের তুলনায় অনেক বেশী। যদিও দেশের সুরক্ষিত বনগুলো আকারে ছোট এবং একটি আরেকটি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। ফলে প্রাণীগুলো ক্রমেই নির্দিষ্ট অঞ্চলে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে এবং জীনগত আদান-প্রদানের সুযোগ কমে যাচ্ছে। তাই গবেষণাটি বাংলাদেশের বন সংরক্ষণনীতি শক্তিশালী করার তাগিদ দিয়েছে। বনের সংরক্ষণ অবশ্যই একটি জাতীয় অগ্রাধিকার হয়ে উঠতে হবে।
তিনি আরও বলেন, “যদি আমরা এখনই এই আবাসস্থলগুলো রক্ষা করার জন্য পদক্ষেপ না নিই, আমরা শুধুমাত্র দুটি প্রজাতির হনুমানই হারাব না, আমরা বাংলাদেশের অমূল্য জীববৈচিত্র্যের একটি অংশও হারাব” গবেষণার সহ-লেখক ড. ডিটমার জিনার বলেন, হনুমানগুলোর উপর সংকরায়নের জীনগত প্রভাব বোঝা এবং সংরক্ষণ কৌশল ঠিক করার জন্য অবশিষ্ট হনুমানগুলোকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং সংকর হনুমানের উপর গভীর গবেষণা এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। “এই গবেষণার ফলাফল একটি সতর্কবার্তা, এটি কেবল শুরু” বলেছেন গবেষণার সহ-লেখক ড. ডিটমার জিনার। “বিপন্ন হনুমানগুলোর জন্য দীর্ঘমেয়াদী সংরক্ষণ কৌশল তৈরির জন্য আমাদের আরও তত্থ্য-উপাত্ত প্রয়োজন। সংকরায়নের বিস্তৃতি, মানুষের ক্রিয়াকলাপের সাথে সম্পর্ক এবং এর সবচেয়ে খারাপ প্রভাবগুলি কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় তা বোঝার জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন। জরিপের সময় সিলেট বিভাগে মোট ৫০০ এর কম চশমাপরা হনুমান এবং ৬০০ এর কম মুখপোড়া হনুমান দেখা যায়। বেশীরভাগ হনুমানের আবাস্থল ক্রমবর্ধমান মানবসৃষ্ট চাপ যেমন বনের জমি বেদখল করে বাড়িঘর নির্মাণ, কৃষিকাজ, কাষ্ঠল উদ্ভিদের চাষাবাদ, গাছ চুরি, এবং অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন ব্যবস্থার কারণে প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে। তাছাড়া বন্যপ্রাণীর অবৈধ শিকার-বাণিজ্য, বিদ্যুতস্পৃষ্ট ও গাড়ী চাপায় মারা যাওয়াসহ নানা কারণে হনুমানগুলিও কমে যাচ্ছে। তাই, এই বিপন্ন প্রাণীগুলো সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার সময় ক্রমেই ফুরিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের বেঁচে থাকা অনেকটাই নির্ভর করে অবিলম্বে গৃহীত পদক্ষেপের উপর যার মধ্যে রয়েছে বন সংরক্ষণ এবং বন্যপ্রাণীর জন্য করিডোর তৈরি করা।
মৌলভীবাজার নিউজ ডেস্ক।। বিডি টাইমস নিউজ