ওয়াশপুর থেকে হযরতপুর পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীর ১৬ কি.মি. ভরাট, দখলের মাধ্যমে গলাটিপে হত্যা করা হয়েছে বুড়িগঙ্গা। বিশ্ব নদী দিবস ২০২৪ উপলক্ষে আজ ২৪ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার সকাল ১০:৩০ মিনিটে বিআইডব্লিউটিএ এর সহযোগিতায় বুড়িগঙ্গা নদী দখল-দূষণ সরেজমিন পরিদর্শন করেছে নদী ও প্রাণ প্রকৃতি সুরক্ষা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নোঙর ট্রাস্ট। বছিলা খেয়া ঘাট থেকে ধর্মগঞ্জ পর্যন্ত সরজমিন পরিদর্শন কর্মসূচিতে উপস্থিত বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতৃত্ব বৃন্দ বুড়িগঙ্গা নদীর বিস্তারিত তুলে ধরেন।

রাজধানীর বুড়িগঙ্গা নদীর মোট দৈর্ঘ্য ৪১ কিলোমিটার। এর মধ্যে ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার ওয়াশপুর থেকে হযরতপুর পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার ভরাট, দখলের মাধ্যমে গলাটিপে হত্যা করা হয়েছে বুড়িগঙ্গা। বাকি ২৫ কিলোমিটার এখনো প্রবহমান রয়েছে। এ সময় বুড়িগঙ্গা নদীর প্রসঙ্গে রিভারাইন পিপল এর মহাসচিব শেখ রোকন বলেন, ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিকভাবে বুড়িগঙ্গার সম্পূর্ণ অংশ শনাক্ত ও চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। নদীটির প্রকৃত উৎসমুখ ও দৈর্ঘ্য নিয়ে বিভ্রান্তি ছিল। যেমন পানি উন্নয়ন বোর্ড ২৯ কিলোমিটার, বিআইডব্লিউটিএ ৪৫ কিলোমিটার, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ২৯ কিলোমিটার এবং পর্যটন করপোরেশন ২৭ কিলোমিটার হিসেবে বুড়িগঙ্গার দৈর্ঘ্য উল্লেখ করেছে। তিনি আর বলেন, কেরানীগঞ্জের হযরতপুর ইউনিয়নের ধলেশ্বরী নদী বুড়িগঙ্গার উৎপত্তিস্থল। নদীটি সমাপ্ত হয়েছে কেরানীগঞ্জের কোন্ডা ইউনিয়নের জাজিরা বাজারের কাছে ধলেশ্বরী নদীতে। এর মোট দৈর্ঘ্য ৪১ কিলোমিটার। ১৯১২ সালে যতীন্দ্রমোহন রায়ের লেখা ‘ঢাকার ইতিহাস’বইয়েও বুড়িগঙ্গার দৈর্ঘ্য ৪১ কিলোমিটার বলে উল্লেখ রয়েছে।

নোঙর ট্রাস্ট এ-র চেয়ারম্যান সুমন শামস বলেন, বুড়িগঙ্গা ধলেশ্বরী নদীর উৎস থেকে বছিলা পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার অংশ সরকারি দলিলপত্র থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। এই অংশকে বাদ দেওয়ার জন্য বুড়িগঙ্গার উৎপত্তি ধলেশ্বরী হলেও বলা হচ্ছে তুরাগ নদী। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি দলিলের ২০০৫ সালের সংস্করণে এই নদীর দৈর্ঘ্য দেখানো হয় ৪৫ কিলোমিটার। একই দলিলের ২০১১ সালের সংস্করণে বলা হচ্ছে, তা ২৯ কিলোমিটার। এই ১৬ কিলোমিটার বাদ দিয়ে দিচ্ছে। বুড়িগঙ্গার প্রবহমান ২৫ কিলোমিটার অংশে সীমান্ত পিলার আছে এবং শুকনা ১৬ কিলোমিটার অংশে সীমান্ত পিলার নেই। বুড়িগঙ্গার ১৬ কিলোমিটার সরকারি নথি থেকে মুছে দেওয়ার মধ্য দিয়ে দখলকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। এই শুকনা অংশে সীমান্ত পিলার দেওয়া হয়নি। পিলার দেওয়া হয়েছে কেবল বুড়িগঙ্গার প্রবহমান অংশে। প্রবহমান অংশে এক হাজারের মতো পিলার পাওয়া গেছে, যার মধ্যে ৭০০ পিলার অক্ষত অবস্থায় নেই। তিনি আরো বলেন এ দেশ নদীমাতৃ অথচ বিদেশ থেকে ধার করে আমরা বিশ্ব নদী দিবস ঘটা করে পালন করি। এ বছরও আন্তোসীমান্ত নদীতে বাংলাদেশের অধিকার প্রতিপাদ্য নিয়ে নোঙর ট্রাস্ট দিনটিকে পালন করছে। এ দেশ নদীমাতৃক অথচ এই দেশে নেই নদীসম্পদ মন্ত্রণালয়। তাহলে নদী অভিভাবক কে?

এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাইশা গ্রুপ নামের একটি বেসরকারি শিল্পগোষ্ঠী বুড়িগঙ্গাসংলগ্ন ভূমি দখল করে ‘আরিশা প্রাইভেট ইকোনমিক জোন’ নামের একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করে। সেটিকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) ২০১৬ সালের ১৪ মার্চ ‘প্রি-কোয়ালিফিকেশন’ সনদ দেয়। মাইশা গ্রুপ ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সিএলসি পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড গঠন করে। আরিশা প্রাইভেট ইকোনমিক জোনে ২০১৭ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ‘সিএলসি ১০৮ মেগাওয়াট এইচএফও ফায়ারড পাওয়ার প্ল্যান্ট’ উদ্বোধন করা হয়। ২০২০ সালে প্রকাশিত জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তথ্যমতে, ৫৪ একরের বেশি নদী ও জলাভূমি দখল করে অর্থনৈতিক অঞ্চলটি নির্মিত। এই স্থাপনাকে অবৈধ চিহ্নিত করে ২০২০ সালের মার্চ মাসে বিআইডব্লিউটিএ উচ্ছেদ অভিযান চালাতে গেলে শিল্পগোষ্ঠীটির পক্ষ থেকে বাধা দেওয়া হয়। ওই বছরের অক্টোবরে এক শুনানিতে বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক এ কে এম আরিফ উদ্দিন বলেন, ‘সংসদ সদস্যের পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণের কারণে বুড়িগঙ্গা নদীর ১৪ কিলোমিটার মরে গেছে।’

বুড়িগঙ্গা নদী পরিদর্শন শেষে বক্তারা বলেন, জলাভূমিতে জীব বা অণুজীবের জীবনধারণের জন্য প্রতি লিটারে ন্যূনতম ৫ মিলিগ্রাম দ্রবীভূত অক্সিজেন বা ডিও প্রয়োজন হয়। এই গবেষণায় দেখা গেছে, কেবল বর্ষা ও শরৎকালে বুড়িগঙ্গায় সেই নূ৵নতম অক্সিজেন থাকে। বর্ষাকালে সদরঘাটে সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৫ মিলিগ্রাম অক্সিজেন পাওয়া গেছে। বাকি চার ঋতুতে (হেমন্ত, শীত, বসন্ত ও গ্রীষ্মকাল) বুড়িগঙ্গায় জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় নূ৵নতম অক্সিজেন থাকে না। হেমন্তকালে সেটি ১–এর নিচে নেমে আসে। উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০১৯ সালে বিআইডব্লিউটিএ বুড়িগঙ্গার পানিতে মিলিত হওয়া ভূগর্ভস্থ নালা বা ড্রেন শনাক্ত করে। এ সময় তারা ৬৮টি নালার তথ্য আদালতে উপস্থাপন করে। এই গবেষণায় দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গার দুই তীরে রয়েছে মোট ১০০টি নালা। এর মধ্য ৪৭টি স্লুইসগেটসহ ও ৫৩টি খোলা। বুড়িগঙ্গার দুই তীর ঘেঁষে ২৫০টি স্থাপনা শনাক্ত করা হয়েছে এই গবেষণায়। যার মধ্যে ১০৮টি কারখানা, ৪৩টি শিপইয়ার্ড, ২৩টি মিল, ২২টি শিল্প স্থাপনা, ১৯টি গুদাম ও ১৭টি ইটভাটা রয়েছে। তবে প্রবেশাধিকার না থাকায় সব স্থাপনার দূষণের মাত্রা ও ধরন এই গবেষণায় পরীক্ষা সম্ভব হয়নি।

এ সময় নোঙর ট্রাস্ট এ-র চেয়ারম্যান সুমন শামস নদী সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ৯ দফা দাবি তুলে ধরেন, ১. দেশের স্বার্থে ‘জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ কনভেনশন ১৯৯৭’ অনুস্বাক্ষর করার মাধ্যমে সকল অভিন্ন নদীর বাধা অপসারণ করে ফারাক্কা-তিস্তাসহ ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি ন্যায্যতার সঙ্গে ব্যবহারের চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে।
২. আদালতের নির্দেশ মতে ১৯৪০ সালের সিএস, এসএ, আরএস, বিএস, ড্যাপ, পরিবেশ এবং জলাধার আইন মোতাবেক সকল নদী, খাল, পুকুর, হাওর বাওর, জলাধার, সংরক্ষণ করতে হবে।
৩. ধলেশ্বরী নদী থেকে বুড়িগঙ্গা নদীর উৎস মুখের গড়ে তোলা মধূমতী মডেল টাউন উচ্ছেদ করে নৌপরিবহন ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
৪. সমুদ্র-পাহাড়, বনভূমি, খাল-বিল, পুকুর, জলাশয়, নদ-নদী দখল-দূষণকারী, বালু খেকো, প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংসকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে।
৫. দেশের নৌপথে নিহত প্রায় ২০,০০০ সকল শহীদের স্মরণে ‘২৩ মে, জাতীয় নদী দিবস’ ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করতে হবে।
৬. জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন কর্তৃক ৩৭,০০০ নদী দখলদারদের মুছে দেয়া তালিকা প্রকাশ করে সকল দখল উচ্ছেদ করতে হবে।
৭. রাজধানীর নড়াই নদীর উপর রামপুরা ব্রীজ-স্লুইচগেটসহ গুলশান, হাতিরঝিল, পান্থপথ, ধানমন্ডি লেক, পিলখানা থেকে বুড়িগঙ্গা পর্যন্ত নৌপথ সচল করতে হবে।
৮. রাজধানীর হারিয়ে যাওয়া ৪৭টি খালসহ সারা দেশের নদ-নদীর উপর স্বল্প উচ্চতার সেতু অপসারণ এবং দেশের সকল খালের উপর নির্মিত কালর্ভাট উচ্ছেদ করে নদীর সাথে সংযুক্ত করতে হবে।
৯. নদী রক্ষায় নদীসম্পদ মন্ত্রণালয় গঠন করে নদী কর্মী ও পরিবেশ কর্মীদের রাষ্ট্রিয় স্বীকৃতি প্রদান এবং জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

সুমন শামসের সঞ্চালনায় পরিদর্শন চলাকালীন ভারসামান সভায় বক্তব্য রাখেন জনাব মিহির বিশ্বাস যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন। নদী গবেষক ও গণমাধ্যম ব্যাক্তিত্ব আমিন আল রশিদ। হাওর অঞ্চলবাসীর আহবায়ক জাকিয়া শিশির। বাংলাদেশ সেভ ওয়াটার মুভমেন্ট এর আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন, পরিবেশ কর্মী মোঃ সেলিম, কথা সাহিত্যিক মনির জামান, বিআইডব্লিউটিএ প্রকৌশলী জনাব মাহমুদুল হাসানসহ নগর ট্রাস্টের সদস্যবৃন্দ। বসিলা এলাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের ধর্মগঞ্জ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা এবং ধলেশ্বরী নদীর মোহনায় গিয়ে আবার সদর ঘাট ফিরে আসে বিআইডব্লিউটিএর জরিপ জাহাজ তুরাগ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে