বাংলাদেশ ব্যাংকের পদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে বিষয়টি নতুন কিছু ছিল না। কেনাকাটা, নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স প্রদান, বিতর্কিত শিল্প গ্রুপগুলোর খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল, বাণিজ্যিক ব্যাংকের বড় অংকের ঋণ অনুমোদনের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেক নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করতেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। এসব কাজে কখনো সরাসরি গভর্নরকে ফোন করতেন তিনি। আবার কখনো ডেপুটি গভর্নর কিংবা নির্বাহী পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের কাছেও জয়ের ফোন আসত। নিজে সরাসরি ফোন করা ছাড়াও কখনো কখনো সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মাধ্যমেও হস্তক্ষেপ করতেন সজীব ওয়াজেদ জয়। মাস তিনেক আগে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের কক্ষে কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তার একটি জরুরি সভা চলছিল। সভাটি ডাকা হয়েছিল ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স সংক্রান্ত আলোচনার জন্য। বৈঠকের মধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ একজন নির্বাহী পরিচালকের (ইডি) সেলফোন বেজে ওঠে। গভর্নর জানতে চান, ‘কে ফোন করেছে?’ ওই নির্বাহী পরিচালক জানান, ‘সজীব ওয়াজেদ জয়।’ নির্বাহী পরিচালকের এমন উত্তরে উপস্থিত কর্মকর্তারা একে অপরের দিকে আড়চোখে তাকান। ফোন রিসিভ করে ওই নির্বাহী পরিচালক গুরুত্বপূর্ণ ওই সভা থেকে বের হয়ে যান। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর ও নির্বাহী পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। যদিও তাদের কেউই নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে এ বিষয়ে নাম উদ্ধৃত করে বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ বলছে, সজীব ওয়াজেদ জয়ের নির্দেশনা আসত মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে সরাসরি কল না করে হোয়াটসঅ্যাপ, স্কাইপের মতো অ্যাপের মাধ্যমে সংযুক্ত হয়ে তিনি নির্দেশনা দিতেন। এ কারণে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পুত্রের নির্দেশনার লিখিত কোনো প্রমাণ থাকত না। তবে ড. আতিউর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, গভর্নর থাকা অবস্থায় নিজে থেকেই প্রতি মাসে সজীব ওয়াজেদ জয়ের কাছে কর্মতৎপরতার প্রতিবেদন পাঠাতেন তিনি। গভর্নরের মেয়াদ শেষ করে অর্থমন্ত্রী হওয়ার প্রলোভনও ছিল তার সামনে। সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে তার ছিল গভীর অন্তরঙ্গতা। জয়ের পছন্দেই তাকে গভর্নর করা হয়েছিল বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। গত দেড় দশকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে। তবে বেশির ভাগ কেনাকাটাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার কেনার ভেন্ডর প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট করে দেয়া থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারণী অনেক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেই সজীব ওয়াজেদ জয়ের হস্তক্ষেপ থাকত। এক্ষেত্রে কখনো নিজে সরাসরি ফোন করতেন, কখনো সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনকারী মন্ত্রীরা ফোন করে তদবির করতেন।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ১ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদে নিয়োগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আতিউর রহমান। চার বছরের মেয়াদ শেষ হলে ২০১২ সালে তাকে দ্বিতীয় মেয়াদে গভর্নর নিয়োগ দেয় শেখ হাসিনার সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা নিয়ে তুমুল সমালোচনার মুখে ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ পদত্যাগ করেন তিনি। আতিউর রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত একাধিক সূত্র বলছে, রিজার্ভ চুরির ঘটনা অর্থ মন্ত্রণালয়কে না জানালেও সজীব ওয়াজেদ জয়কে জানিয়েছিলেন আতিউর রহমান। জয়ের পরামর্শেই রিজার্ভের অর্থ উদ্ধারের জন্য ভারতীয় নাগরিক রাকেশ আস্তানার প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয়। যদিও তথ্যপ্রমাণ ধ্বংস করা ছাড়া ওই সময় আর কোনো কাজই হয়নি।
আতিউর রহমান গভর্নর থাকা অবস্থায় ২০১৩ সালে একসঙ্গে নয়টি বেসরকারি ব্যাংকের লাইসেন্স দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময় লাইসেন্স পাওয়া ব্যাংকগুলো হলো ফারমার্স ব্যাংক (পরবর্তী সময়ে নাম পরিবর্তন করে পদ্মা ব্যাংক করা হয়), মেঘনা, মিডল্যান্ড, মধুমতি, এনআরবি, এনআরবি কমার্শিয়াল, এনআরবি গ্লোবাল (পরবর্তী সময়ে নাম পরিবর্তন করে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক), সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। এ ব্যাংকগুলোর অনুমোদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক একজন নির্বাহী পরিচালক ও একজন মহাব্যবস্থাপক বণিক বার্তাকে বলেছেন, ‘রাজনৈতিক বিবেচনায় এ ব্যাংকগুলোকে অনুমোদন দেয়ার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতসহ অনেক প্রভাবশালীর তদবির ছিল। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি চাপ এসেছিল সজীব ওয়াজেদ জয়ের কাছ থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিচের দিকের অনেক কর্মকর্তা ব্যাংক দেয়ার বিপক্ষে থাকলেও আতিউর রহমান পক্ষে ছিলেন। তিনি ওই সময় আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীসহ বিভিন্ন দলীয় সমাবেশে গিয়েও বক্তব্য দিতেন।
গভর্নরের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততার কারণেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান-পরিচালকরা অনিয়ম-দুর্নীতিতে উৎসাহিত হয়েছিলেন। পর্ষদের চাপের কারণে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষও নানা অনিয়মে জড়িয়েছে। ওই সময় বেসিক ব্যাংক লুট, সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি, জনতা ব্যাংকে বিসমিল্লাহ গ্রুপ, এননটেক্স ও ক্রিসেন্ট কেলেঙ্কারির মতো বৃহৎ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছিল। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ড. আতিউর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকার কিংবা গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের কম-বেশি চাপ তো ছিলই। তবে আমি চেষ্টা করেছি সেসব চাপ আমার সাধ্যমতো মোকাবেলা করতে। যখন নতুন করে ব্যাংক দেয়ার প্রয়োজন নেই বলেছিলাম, তখন সে সময়ের অর্থমন্ত্রী প্রকাশ্যে বলেছিলেন তারা রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক দেবেন। যখন সরকারি ব্যাংক ও ব্যক্তি খাতের ব্যাংক দুই আইনে চলছিল, তখন বলেছিলাম একই খাতের জন্য দেশে দুই আইন চলতে পারে না। তখন তিনি আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন। স্বাধীন গভর্নর হিসেবে যখন আর চলতে পারছিলাম না, প্রকাশ্যে গালমন্দের শিকার হচ্ছিলাম তখন স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিংবা তার পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অন্যায় চাপ অনুভব করিনি। সর্বক্ষণ মাথা উঁচু করেই চলার চেষ্টা করেছি। আতিউর রহমানের পদত্যাগের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদে নিয়োগ পান তৎকালীন অর্থ সচিব ফজলে কবির। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ থেকে ২০২২ সালের ৩ জুলাই পর্যন্ত গভর্নর ছিলেন তিনি। ফজলে কবির গভর্নর থাকা অবস্থায় ২০১৮ সালের ১১ অক্টোবর মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) ‘নগদ’ চালু হয়। যদিও মোবাইল ব্যাংকিং হিসেবে পরিচিত সেবাটি চালুর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো অনুমোদনই নেয়া হয়নি। ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নগদের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। পরবর্তী সময়ে নগদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সজীব ওয়াজেদ জয়কে উপস্থিত থাকতেও দেখা যায়।
সাবেক গভর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র জানায়, নগদকে লাইসেন্স দিতে সজীব ওয়াজেদ জয় গভর্নর ফজলে কবিরকেও ফোন দিয়েছিলেন। ফজলে কবির নিজেও বণিক বার্তার কাছে স্বীকার করেছেন, নগদের লাইসেন্স ইস্যুতে সজীব ওয়াজেদ জয় তার সঙ্গে ভার্চুয়ালি কথা বলেছেন। সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। ২০০৯ সাল-পরবর্তী সময়ে পরিবেশ তৈরির পর ২০১৬ সাল থেকে একের পর এক বেসরকারি ব্যাংক দখল হতে শুরু করে। ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক দখলে নেয় এস আলম গ্রুপ। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) থেকে উদ্যোক্তা পরিচালকদের হটিয়ে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজ্জামান বাবুর পরিবার। আইএফআইসি ব্যাংকের ওপর পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন সালমান এফ রহমান। উদ্যোক্তা পরিচালকদের বের করে দিয়ে এনআরবি ব্যাংক পর্ষদের নিয়ন্ত্রণ নেন মাহতাবুর রহমান নাসির। এভাবে দেশের অন্তত দুই ডজন বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদে পরিবার ও আওয়ামীতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়। যদিও এসব ব্যাংকের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।
ফজলে কবিরের পর ২০২২ সালের ১২ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদে নিয়োগ পান তৎকালীন অর্থ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার। গত ৯ আগস্ট পর্যন্ত গভর্নর পদে ছিলেন তিনি। তবে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই আব্দুর রউফ তালুকদার পলাতক। বাংলাদেশ ব্যাংকের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র গভর্নর, যিনি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পালিয়েছেন। গত জুনের শুরুতে দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ব্যাংক হিসেবে ‘নগদ ডিজিটাল ব্যাংক পিএলসি’র লাইসেন্স ইস্যু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ব্যাংকের অনুমোদন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রেও সজীব ওয়াজেদ জয়ের হস্তক্ষেপ ছিল বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, গভর্নর হিসেবে আব্দুর রউফ তালুকদারের ভূমিকা ছিল রাজনৈতিক কর্মীর মতো। সরকারের পক্ষ থেকে যে নির্দেশনা আসত, তিনি কেবল সেটিরই বাস্তবায়ন ঘটাতেন। তিনি সজীব ওয়াজেদ জয়ের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। নগদ ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স অনুমোদনের ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রী পুত্রের ভূমিকা ছিল।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গভর্নর পদে নিয়োগ পান ড. আহসান এইচ মনসুর। গত ১৪ আগস্ট গভর্নর হিসেবে তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এখন পর্যন্ত ১১ বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে এমএফএস প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’-এর ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়। স্থগিত করা হয় নগদকে দেয়া ডিজিটাল ব্যাংকিং লাইসেন্স। গত ২২ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘নগদের মালিকানা ও অনুমোদন নিয়ে প্রশ্ন আছে। নগদে যে পরিমাণ টাকা জমা আছে, নিয়মের বাইরে তার চেয়ে বেশি ডিজিটাল অর্থ তৈরি করেছে। প্রতিষ্ঠানটি যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায় ও কেউ প্রতারিত না হন, সেজন্য প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।’