সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তার শাসনামলে ‘নৃশংসতার’ অভিযোগের মুখোমুখি করতে প্রত্যার্পণের দাবি ওঠায় বাংলাদেশের সাথে ভারতের আগের ‘ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক চাপের মধ্যে’ পড়ে যাচ্ছে বলে এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। শুক্রবার হংকংভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টে বিমান মুখার্জীর এক লেখায় এ রমকটাই বলা হয়েছে।

পত্রিকাটি লিখেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত পাঁচ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। এতে তার ১৫ বছরের শাসনের পতন ঘটে। ক্ষমতার দখল ধরে রাতে নির্বাচনে কারচুপি, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং জোরপূর্বক গুমের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপক অভিযোগ দ্বারা তার শাসনামলকে চিহ্নিত করা হয়।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের জনগণ বিচারের মুখোমুখি হওয়ার জন্য হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার দাবি করছেন।

তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, তাঁকে ফেরত আনতে হবে, নইলে বাংলাদেশের জনগণ শান্তিতে থাকবেন না। যে ধরনের নিষ্ঠুরতা তিনি দেখিয়েছেন, তাতে এখানে প্রত্যেকের সামনে তাঁর বিচার করা দরকার।’

পত্রিকাটি লিখেছে, বাংলাদেশের বিরোধী দল ও কর্মীরা অভিযোগ করেছিলো যে, জুলাই থেকে আগস্ট পর্যন্ত সরকারবিরোধী বিক্ষোভে পুলিশ এবং শেখ হাসিনার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সমর্থকরা অনেককে গুলি করেছে। এতে শত শত মানুষ নিহত এবং হাজার হাজার আহত হয়েছে।

ড. ইউনূসের বিবৃতিটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর আলোকপাত করে, কিন্তু নয়াদিল্লি তার দাবিতে রাজি হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে বিশ্লেষকদের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট।

হরিয়ানার জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক অধ্যাপক শ্রী রাধা দত্ত বলেন,  এ সম্ভাবনা খুবই কম যে, ভারত হাসিনাকে হস্তান্তর করবে। যা হয়েছে তা হলো, এখন বাংলাদেশের প্রতিটি কর্মকর্তা ও স্টেকহোল্ডার শেখ হাসিনা এবং ভারতবিরোধী অবস্থান নিতে চায়।’

গত শুক্রবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণবীর জয়সওয়ালকে শেখ হাসিনার প্রত্যার্পণের সম্ভাবনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো। তিনি এটাকে ‘আনুমানিক বিষয়’ বলে উল্লেখ করেন। বলেন, আমরা আগেই বলেছি, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নিরাপত্তার কারণে খুব অল্প সময়ের নোটিশে ভারতে এসেছিলেন। এই বিষয়ে আমাদের আর কিছু বলার নেই।

শেখ হাসিনাকে সেদেশে আশ্রয় দেওয়ায় সংসদীয় অধিবেশনে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলি দ্ব্যর্থহীনভাবে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছিলো। পাশাপাশি, তাকে আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্তের জন্য ভারত সরকারকে সমর্থন করেছিলো।

শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাদের পাশাপাশি হাসিনার শাসনকে সমর্থন করার অভিযোগে তার দলের শতশত নেতাকর্মী আন্ডারগ্রাউন্ডে অথবা ভারত ও অন্যান্য দেশে পালিয়ে গেছে। তাদের মধ্যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করার সময় ঢাকার একটি নদীবন্দরে গ্রেপ্তার করা হয়।

লন্ডন-ভিত্তিক লেখক প্রিয়জিৎ দেব সরকার সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে বলেছেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর নেতাদের জন্য ধারাবাহিকভাবেই নিরাপদ আশ্রয়স্থল ভারত। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা তার নিরাপত্তা ও পরিবারের মঙ্গলের জন্য এর আগেও ভারতে থেকেছেন।

প্রিয়জিৎ দেব সরকার আরও বলেন, ভারতীয় আমলাতন্ত্র স্বল্প ও মধ্য মেয়াদে এই আতিথেয়তার বিপরীত কিছু করবে, এটা একেবারেই অসম্ভব।

শ্রী রাধা দত্ত বলেন, ভারতে হাসিনার উপস্থিতি নিয়ে উত্তেজনা থাকলেও বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নেতারা সম্ভবত দৃঢ় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করবেন। কারণ, তা না হলে দুই দেশই সম্পর্ক হারিয়ে ফেলতে পারে। তিনি বলেন, আমাদের ঐতিহাসিকভাবে (দ্বিপাক্ষিক) সম্পর্ক ছিলো এবং আমরা ঘনিষ্ঠ হতে চাই। কারণ এটি উভয় দেশের জন্য মঙ্গলজনক।

শেখ হাসিনার শাসনামলে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দৃঢ় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছিল, বিশেষ করে বাণিজ্য ক্ষেত্রে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিলো ১৩ বিলিয়ন ডলার।

হাসিনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়ে দিল্লির উদ্বেগের কারণে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। ড. ইউনূস বলেছেন, সংখ্যালঘুদের অবস্থাকে এতো বড় আকারে চিত্রিত করার চেষ্টা করার বিষয়টি আসলে অজুহাত মাত্র।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দিল্লির অপ্রমাণিত এসব অভিযোগ ভারতের অভ্যন্তরে ইসলামোফোবিয়াকে উসকে দিতে পারে। এছাড়া গত মাসে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার কারণেও বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কে টানাপড়েন দেখা দিয়েছে। উত্তরপূর্ব ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডম্বুর বাঁধ থেকে পানি ছাড়ার কারণে এই বন্যা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ।

তথ্যঃ একাত্তর ও সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে