পুরান ঢাকার নিমতলী থেকে বেইলি রোড। ট্র্যাজেডি আসে, ট্র্যাজেডি যায়। মৃত্যু আর আহাজারিতে ভারী হয় ঢাকার বাতাস। তবুও মানুষের সুরক্ষার কথা চিন্তা না করে ঢাকা শহরে গড়ে উঠছে বড় বড় অট্টালিকা। এসব ভবন হয়ে উঠেছে অনেকটা টাইম বোম।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির তথ্যমতে, শুধু ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুর এলাকাতেই রয়েছে প্রায় ৩০০ রেস্তোরাঁ। জিগাতলা থেকে সাতমসজিদ রোড পর্যন্ত রয়েছে ঢাকার সবচেয়ে বেশি রেস্তোরাঁ। এই সংখ্যা প্রায় একশ হবে। কিছু কিছু বহুতল ভবনের প্রতিটিতে অন্তত ডজনখানেক রেস্তোরাঁ রয়েছে। ফলে অপরিসর সিঁড়ি ও লিফটে চলাচলে গ্রাহকদের ভিড় লেগেই থাকছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে বেইলি রোডের মারাত্মক অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের মর্মান্তিক প্রাণহানির ঘটনার পরেই আলোচনায় এসেছে এমন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় কতটুকু নিরাপদ আমরা। ধানমন্ডির এসব এলাকায় বহু সংখ্যক বাণিজ্যিক ভবন থাকায় সেখানে রেস্তোরাঁ ব্যবসা পরিচালনা করতে ভবনের কিছু নিরাপত্তা বিধিমালা ও মানদণ্ড অনুসরণ করতে হয়। যেমন কোনো ভবনে রেস্তোরাঁ থাকলে সেখানে অগ্নি-নির্বাপক ব্যবস্থা, জরুরী নির্গমণ পথ, পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা থাকা দরকার। কোনো দুর্ঘটনার সময়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও গ্রাহকদের সতর্ক করতে বিভিন্ন রকমের নিরাপত্তা সাইন বা নির্দেশক থাকতে হয়।
বহুল রেস্তোরাঁ থাকা এসব ভবনগুলো যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে কি না সেই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠছে। রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মতে, একটি রেস্তোরাঁ শুরু করতে তাদের ১২ রকমের সনদ নিতে হয়। তবে কতগুলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যথাযথভাবে এসব সার্টিফিকেট নিয়েছে বা যথাযথ মানদণ্ড মেনে পরিচালিত হচ্ছে- তা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়।
স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, সাতমসজিদ সড়কের বেশিরভাগ ভবনই প্রকৃতপক্ষে বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য, রাজউক যেগুলো এফ-১ ক্যাটাগরি-ভুক্ত করেছে। এগুলোতে শুধু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অফিস স্থাপনের অনুমতি রয়েছে। কিন্তু, অফিস স্পেসের চাহিদা তেমন না থাকায় এবং সে তুলনায় রেস্তোরাঁ ব্যবসার উচ্চ মুনাফার কারণে- ভবন মালিকরা এসব নিয়ম ভঙ্গ করতে শুরু করেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব ভবনে রেস্তোরাঁ বেশি, সেখানে আগুনের ঝুঁকিও উচ্চ। এজন্য বিল্ডিং কোড ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে রাজউকের মতো নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। স্থপতি মোস্তফা খালিদ পলাশ বলেন, ‘একটি ভবন যত ভালোভাবেই বানানো হোক না কেন, সেটা যদি সম্পূর্ণ রেস্টুরেন্ট ভবনে রূপান্তরিত হয়, তাহলে ঝুঁকি থেকেই যাবে। সমস্যা হলো আইনের মধ্যে ফাঁক আছে।’ অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে ডেভেলপার কোম্পানি ও ভবন মালিকদের উদাসীনতা নিয়েও আক্ষেপ করেন তিনি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, বাণিজ্যিক ভবনকে রেস্তোরাঁ ভবনে রুপান্তরিত করাটা অবৈধ এবং এটা হতে দেয়াই উচিত নয়। তিনি আরও বলেন, বিধিমালা অনুযায়ী অনেক ভবনের দুটি করে সিঁড়ি রয়েছে। কিন্তু, অনেক ভবনেই ফায়ার এক্সিট সিঁড়ি মালামাল রাখার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে কর্তৃপক্ষের উচিত হবে, বিষয়টি নিরুৎসাহিত করা। আদিল মোহাম্মদ বলেন, অনেকেই ভবনের ব্যবহার পরিবর্তন করে অ-আবাসিক ক্যাটাগরিতে ফেলে। এই ‘অ-আবাসিক’ নামের ব্যবহার করে আবাসিক ভবন ভিন্ন উদ্দেশে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কঠোর হতে হবে। এদিকে রাজউকের একজন পরিচালক মোহাম্মদ শামসুল হক বলেন, ‘সিটি কর্পোরেশন ও ফায়ার সার্ভিসের অনুমতি নিয়ে ভবনের ক্যাটাগরি পরিবর্তন না করা হলে- বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত ভবনে রেস্তোরাঁ করা যাবে না।’
সাম্প্রতিক এক জরিপে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স জানিয়েছে, আবাসিক ও বাণিজ্যিকসহ রাজধানীর ৯০ শতাংশ ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। বারবার সতর্ক করার পরও অনেক ভবনের মালিক তা গ্রাহ্য করছেন না। এর মধ্যে ২৩ শতাংশ ভবনকে অতি-ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হিসেবে চিহ্নিত করেছে ফায়ার সার্ভিস।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বলছে, অগ্নিনিরাপত্তা ও অগ্নিঝুঁকি মোকাবিলার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনায় নিয়মিত জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।