বিশেষ সাক্ষাৎকার।। বিডি টাইম্স নিউজের সাক্ষাৎকারে প্রখ্যাত অভিনেতা ও নাট্যকার মামুনুর রশীদ
মামুনুর রশীদ, নাট্যকার, নাট্যনির্দেশক ও অভিনেতা। স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশের মঞ্চ আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। নাট্যকলায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১২ সালে একুশে পদক পান তিনি।বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন, ভাষার ব্যবহার ও অপব্যবহার, সংস্কৃতিচর্চা, সাংস্কৃতিক সংগঠনের ভূমিকা নিয়ে কথা বলেছেন বিডি টাইম্স নিউজের সাথে।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশরাফুল রাণা
ভাষা আন্দোলন আমাদের দেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আন্দোলন, যে আন্দোলন আমাদের আত্মপরিচয় এবং ভৌগলিক স্বাধীনতা চিন্তার একটা বড় প্রকাশ। এইভাবে বড় প্রকাশ যে, একটা সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে, ধর্মের ভিত্তিতে দেশটা ভাগ হয়ে গেল। দেশ ভাগ হওয়ার পর মানুষের স্বপ্নটা প্রথম স্বপ্নটা ধুলিস্যাৎ হল ভাষার উপর আক্রমণের মধ্য দিয়ে। তৎকালীন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কার্জন হলে যে কথাটা বলে ফেলল ‘উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ অথচ এদেশে তখনকার যে জনসংখ্যা পাকিস্তানের যেকোনো প্রদেশের চাইতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা। এখানে বড় একটা জনসংখ্যাকে একেবারেই অবহেলা করে এই ধরনের বক্তব্য দেওয়ার পর এদেশের মানুষের আর কোন আশা থাকলো না।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে তাদের চিন্তা-ভাবনা, স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা, অর্থনৈতিক মুক্তি কোনটাই সম্ভব নয়। এজন্যই তখনকার যারা রাজনৈতিক কর্মী, শিল্পী, সাহিত্যিক, বিশেষ করে ছাত্র তারা সবাই একযোগে আন্দোলনের নেমে পড়লেন। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন সেটা নিয়েও যখন সমস্যার সমাধান হলো না তখন ১৯৫২তে ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষা আন্দোলন একটা পরিণতির দিকে চলে গেল এবং পরবর্তীকালে তারা মানতে বাধ্য হলো উর্দু নয়, বাংলাও একটি রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পাবে। সেসময় বাংলা একাডেমী গঠন করা এবং কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড করার চিন্তা এগুলো এল কিন্তু রাজনীতিতে প্রবলভাবে একটা স্বৈরাচারী মনোবৃদ্ধি দেখা গেল। তখন যুক্তফ্রন্ট গঠন হল, ১৯৫৪ সালে সেটাকে ব্যর্থ করে দিয়ে নানান নিষ্পেষণ এবং নিপীড়নের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান যখন পূর্ব বাংলাকে কোন ভাবেই করায়ত্ব করতে পারছিল না তখন আইয়ুব খান(কমান্ডার ইন চীফ,পাকিস্তান আর্মি) জারি করল ‘মার্শাল ল’। কিন্তু ‘মার্শাল ল’ই সমাধান নয়, সমাধান হলো না তাদের জন্য, কারণ আন্দোলন থামলো না, ষাটের দশকে প্রবল ভাবে আন্দোলন শুরু হলো একের পর এক শিক্ষা আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন। তৎকালীন সময়ে আমাদের কবি, শিল্পী সাহিত্যিক, সাংবাদিক সবাই মিলে একযোগে বাংলা ভাষা এবং বাংলা সংস্কৃতির আবিষ্কারের একটা পথ খুলে গেল। এই সময়েই রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হল। তখন রবীন্দ্রনাথকে বিরোধিতা করে পাকিস্তানের মিডিয়া গুলোকে নিষিদ্ধ করা হল, রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী পালনে বাধা দেয়া’সহ নানান কর্মকাণ্ড হল। ষাটের দশকে আমরা যেটা লক্ষ্য করেছি, প্রত্যেকের মধ্যেই বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে আবিষ্কারের একটা আকাঙ্ক্ষা শুধু নয় একটা কর্ম পরিকল্পনাও তৈরি হতে লাগলো এবং সেই সাথে বেশ কিছু লিটিল ম্যাগাজিন, নিয়মিত পত্রিকা, সাহিত্য পত্রিকা, সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে লাগলো। শেষের দিকে আর কোনোভাবেই পাকিস্তান আমাদের দাবি-দাওয়া মানছে না, তখন আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ১৯৬৯ সনে যে গণঅভ্যুত্থান হলো সেই গণঅভ্যুত্থানে চূড়ান্ত রূপ পেল অন্তত আমাদের ভোটের অধিকারকে মেনে নেওয়ার কিন্তু ভোটে আমরা বিজয়ী হলেও রাষ্ট্রক্ষমতা আমাদের হাতে এলো না তখন আন্দোলন আরো দুর্বার রুপ পেল মার্চ মাসে ১৯৭১ সালে। যেটার পথ ধরেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল, মুক্তি সংগ্রামের পিছনে একটা প্রবল প্রেরণা হচ্ছে ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’ ভাষার মুক্তি আন্দোলন। এই ভাষার মুক্তির আন্দোলনের পথ ধরেই সাংস্কৃতিক মুক্তি এবং সেই সাংস্কৃতিক মুক্তির পথ ধরেই মুক্তিযুদ্ধে আমরা অবতীর্ণ হলাম।
পৃথিবীতে অনেক জাতি আছে যাদের মাতৃভাষা স্বীকৃতি নেই, আমরা যদি দক্ষিণ আমেরিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার দিকে তাকাই তাহলে সে দেশগুলোতে দেখব, তাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। তাদের যে ভাষা ছিল সে ভাষায় তারা লিখতো, পড়তো ও বলতো, কেউ পুর্তগীজ, স্প্যানিশ অথবা ইংরেজি ভাষায় তারা কথা বলে। তাদের আন্দোলনের একটা মুখ্য কাজ হচ্ছে ‘Give me my language, give me my Culture’। আফ্রিকায় যে দাসদেরকে বয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাদের একটা আন্দোলন আছে ‘RASTA FARIAN’ Back-to-Africa। তারা আফ্রিকাতে ফিরতে চায়, আবার তাদের ভাষার মর্যাদা চায়, এই যে ভাষা হারিয়ে ফেলা এখন পৃথিবীতে প্রতিদিনই একটি ভাষার মৃত্যু হচ্ছে তার কারণ ক্ষুদ্র জনসংখ্যা।
আমাদের দেশে পাংকু বলে একটা জাতিসত্তা আছে, এই পাংকু জাতিতে বাংলাদেশ ও ভারত মিলিয়ে কথা বলে মাত্র ৩১০০’জন। এখন এই ভাষাটাকে রক্ষা করা কঠিন কারণ ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী। তারা প্রাণপণের সেই ভাষা রক্ষা করে এছাড়াও আরও অনেক ভাষা আছে যাদের অস্তিত্বকে তারা টিকিয়ে রাখতে পারছে না। আমাদের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য এটাই যে, পৃথিবীর সকল মানুষ যেন তাদের মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে, মাতৃভাষায় শিক্ষা নিতে পারে, মাতৃভাষায় নিজেকে প্রকাশ করতে পারে, এটাই আমাদের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের একটা বিরাট বড় তাৎপর্য। কাজেই মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ, মাতৃভাষায় জীবনযাপন একটা জাতির জন্য খুবই প্রয়োজন তবে বৈদেশিক যোগাযোগের জন্য আমাদের স্প্যানিশ, ফরাসি, ইংরেজি ভাষাসহ নানান ভাষা লাগে, সেটা আমরা করব কিন্তু আমাদের মুখ্য বিষয়টা হবে আমাদের মাতৃভাষা, যে মাতৃভাষার প্রেরণা আমাদেরকে একুশে ফেব্রুয়ারি দিয়েছে।
ইংরেজিতে ভুল হলে আমরা বলি ভুল হয়েছে, কিন্তু বাংলায় আমরা যে কত ভুল বলি, বানান ভুল করি, কত ভুল শব্দ উচ্চারন করি এবং ভুল বাক্য নির্মাণ হতে থাকে কিন্তু তখন কেউ বলে না যে ভুল হয়েছে। মাতৃভাষা ভুল করাটা কোন অপরাধ না বিদেশী ভাষা ভুল করাটা অপরাধ। একটা দেশে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় শিক্ষা দেওয়াটা আমাদের দেশের একটা বিরাট বড় সংকট। এখানে ইংরেজি শিক্ষা দেওয়ার জন্য ইংরেজি স্কুল আছে, আরবি পড়ানোর জন্য মক্তব-মাদ্রাসা আছে, আবার সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে এই যে এতগুলো ভাষায় আমাদেরকে শিক্ষাদান করা হচ্ছে এটা আমাদের জন্য বিপর্যয়কর। এই কারণে যারাই ইংরেজি স্কুল কিন্ডার গার্ডেন থেকে শুরু করে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করে তারা কিন্তু এদেশে থাকে না বা থাকছে না। আমাদের অর্থনীতিতে তাদের কোন ভূমিকা নেই। একটা বড় বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশের যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রয়েছে সেই ছেলে-মেয়েরাই কিন্তু প্রশাসন থেকে শুরু করে সরকারি কর্মকর্তা বা শিক্ষকতা সবই তারা করছে। তাহলে একটা বড় মেধার অপচয় হচ্ছে একদিক থেকে, আর যেটা নাকি একেবারেই ধর্ম শিক্ষার বিষয়টি তারা আমাদের অর্থনীতিতে বড় একটা ভূমিকা পালন করতে পারছে না, তাহলে বড় একটা অংশ আমাদের বাইরেই থেকে যাচ্ছে। আর যারা থেকে যাচ্ছে এদের মেধা নষ্ট হচ্ছে এবং আমরা তাদের মেধার থেকে কিন্তু বঞ্চিত হচ্ছি।