মুহম্মদ আশরাফুল, নিজস্ব প্রতিবেদক।। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল দেশের বেশ কয়েকটি জায়গায়। প্রথমে চট্টগ্রামের একাধিক জায়গায় যেটা বেলাল মোহাম্মদ, মোস্তফা কামাল, আবুল কাশেম সন্দীপ প্রথমে চট্টগ্রামে শুরু করে। চট্টগ্রামেও জায়গায় বদলাতে হয় দুই জায়গায়। তারপর তাঁরা চলে যান আগারতলা। আগারতলাতেও বিভিন্ন জায়গা বদলাতে হয়। সর্বশেষ চলে যান কোলকাতা।
বলছিলেন রণাঙ্গণের কণ্ঠযোদ্ধা নিরঞ্জন অধিকারী। বিডি টাইম্স নিউজকে তিনি বলেন, আমি তখন ঢাবি’র তৃতীয় বর্ষের ছাত্র, আমরা তো আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যেই আছি। সংগ্রামের এক পর্যায়ের অনির্দিষ্টকালের জন্য ঢাবি বন্ধ ঘোষণা করে ২’রা মার্চ। তো আমি তখন গ্রামের বাড়িতে চলে যাই। সেখানেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তৈরি করে আমি আহ্বায়ক হয়ে আন্দোলন সংগ্রাম শুরু করি।
আমাদের অন্দোলনের কথা জেনে মিলিটারি চলে আসে এবং ওইখানে একটা ঘটনা ঘটে যায়। এটা হলো, ঢাকার যে প্রোগ্রাম তার সঙ্গে মিল রেখে ২৩’রা মার্চ পাকিস্তানের গন প্রজাতন্ত্র দিবসকে ডিফাইন করে ঢাকায় পতাকা উত্তোলন করা হয়। সেই প্রোগ্রামের সংগে মিল রেখে আমরাও…। আমার বাড়ি মানিকগঞ্জ জেলার দৌলতপুর উপজেলার খলসী ইউনিয়নের বিনোদপুর গ্রামে।তো খলসী ইউনিয়ন চত্তরে আমরা…. এই এক দর্জি দাদা আমাদের পতাকা বানিয়ে দেন। তিনিও তাহলে স্বাধীনতা সংগ্রামের হয়ে যান।তখন ছিলো সবুজের মধ্যে লাল হলুদ। তারপর হলুদ রঙের বাংলাদেশের মানচিত্র। তো এই পতাকা। আমি তো ছোট মানুষ।
ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ক্ষিতীশ চন্দ্র বসু উঁনি তুললেন এই বাংলাদেশের পতাকা, একজন মাস্টার সাহেব তুললেন কালো পতাকা আর আমি পাকিস্তানের পতাকাটা ম্যাচের কাঠি দিয়ে পুড়িয়ে দিলাম। তারপরে তো মিলিটারি এসে গেলো। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমাদের আর আন্দোলন সংগ্রাম এভাবে চালানো ঠিক হবে না।আমি বাড়ি ছেড়ে দিয়েছিলাম। সৌভাগ্যের বিষয় আমি যেদিন বাড়ি ছেড়ে যাই তার পরের দিনই আমাকে ধরতে আসে। এই ইউনিয়ন পর্যায়ে যাদের আমরা রাজাকার বলি তারা মিলিটারি সহ। তখন ওরা একটা শান্তি কমিটি বানিয়ে ছিলো। তো ওদের ভাষায় শান্তি কমিটি আমাদের জন্য এটা হচ্ছে অশান্তি কমিটি। আর শান্তি কমিটি হচ্ছে যারা স্বাধীনতা পক্ষে জড়িতদের ধরিয়ে দিবে, পাকিস্তানের পক্ষে প্রচার করবে। তো আমাকে পায়নি আমি তখন বাড়ি থেকে দূরে আমার এক ফুফুর বাড়িতে ছিলাম। এই ইউনিয়নে থাকাও ঠিক হবে না। আর একটা ইউনিয়নে চলে যাই। সেখানে দেখি যে বিভিন্ন জায়গা পুড়িয়ে দেয়। যাদের বাড়ি ঠাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে তাদের বহু লোক গিয়ে আমার ওই চাচাতো বোনের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। এতো ভিড়ের মধ্যে থাকা ঠিক হবে না।
ঢাকা আরিচা রোড়ের দুপাশে পোড়াতে পোড়াতে গেছে মিলিটারিরা।আমার এক চাচাতো বোনের বাড়ি সেটাও পুড়িয়ে দিয়েছে। এখানে যেহেতু পুড়িয়ে দিয়েছে এখানে আসবে না। আমি তখন ওখানে লুকিয়ে ছিলাম। তো ভোর বেলা নদীতে গোসল করে ঘরের মধ্যেই থাকতাম। ওইখান থেকে আর এক ফুফুর বাড়ি চলে যাই। সেটা হচ্ছে হরিরামপুর থানায়।সেইখানে আমি, কবি অসীম সাহা আমার ক্লাস মেট ( ঢাবি একসঙ্গে পড়েছি)ওঁর এক আত্মীয়, অসীম সাহা তাঁর স্ত্রী তাঁদের বড় ছেলেটা ছোট কোলে আর কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। একজনের নাম শাহাদাৎ হোসেন। বাকীদের নাম মনে নাই। আমরা এক সঙ্গে শরনার্থীদের সাথে মিশে আমরা কোলকাতা রওনা হই।একসময় হেঁটে,একসময় নৌকায় আমরা কোলকাতায় গিয়ে অসীম সাহা’র ওই আত্মীয়’র বাড়িতে পৌঁছাই।তারপর আমাদের তো সবার পা ঠা ফুলে গেছে। আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম। ওঁরা আমাদের জন্য আলু ভর্তা ভাত করে রাখলো।এমন করে খেলাম যে কখনও আলু ভর্তা দিয়ে ভাত খাইনি।
আমাদের বাংলাদেশের নেতারা শিয়ালদহ শ্রীনিকেতন নামে একটা হোটেল ছিলো।আর কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতা সহায়ক একটা সমিতি হয়ে ছিলো। ওইখানে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের প্রগতিশীল এক প্রফেসর ছিলেন অজয় রায়।তিঁনি, আমাদের প্রফেসর আনিসুজ্জামান এঁরা কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়ক সমিতি ওখানে কাজ করতেন।তো সেইখানে আমার দুই সিনিয়র ফ্রেন্ড ( আমার বড় ভাই) জগন্নাথ হলের একজনের নাম কমল কৃশ্ব গুহ আর একজন মলয় ভৌমিক।ওঁরা আমাকে দেখে বলে,আরে তোমাকেই তো খুঁজছি চলো।ওঁরা ধরে বালিগঞ্জ যেখান থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান হতো সেখানে নিয়ে গেলো। নিয়ে গিয়ে তখন তো আমি নাম জানতাম না। আশরাফুল আলম, বেলাল মোহাম্মদ, শাহজাহান ভাই(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সিনিয়র ছিলো) আমাকে তাঁরা প্রশ্ন করলেন তুমি একা এসেছো? আমি যদি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আমার নামে প্রচার করি তাহলে আমার বাড়ির যারা আছে তাদের উপর অত্যাচার হতে পারে এজন্য একটা ছদ্মনাম বলো।তো মুখে এসে গেলো সবুজ চক্রবর্তী। এই সবুজ চক্রবর্তী নামেই আমি আমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যাবতীয় অনুষ্ঠানাদি করেছি।রক্তসাক্ষ্য,অগ্নিশিখা এ সমস্ত অনুষ্ঠানে কবিতা কথিকা পড়েছি। ওখান থেকে আবু সাঈদ খান( এখন বিভিন্ন পত্রিকায় ছিলেন) একটা পত্রিকা বার করলেন। আমি, কমল কৃশ্নগুহ, মলয় ভৌমিক তাঁর সহযোগী হলাম।সেখানে আমি সবুজ চক্রবর্তী, নিজস্ব নিবন্ধকার বিভিন্ন নামে একাই প্রায় পত্রিকা কাজ করতাম।পত্রিকার নাম ছিলো উত্তাল পদ্মা।এটা আমাদের বাংলাদেশ জাদুঘরে একটা কপি সংরক্ষিত আছে।তো এই পত্রিকার কাজ, স্বাধীন বাংলা বেতারের কাজ, অনুস্ঠানাদি কাজ.. কিন্তু আমি তাতে সন্তুষ্ট হলাম না।
আমাদের ওখানকার আমাদের যে এমপি সিদ্দিকুর রহমান উঁনি কল্যানীতে ছিলেন।ওঁনার সাথে দেখা করলাম।ঠিক আছে আমরা যখন আবার মুক্তিযুদ্ধে আবার যখন লোক পাঠাবো তখন তোমাকে আমি… কিন্ত..কমল দা আর মলয় দা তাঁরা বললেন,দ্যাখো একজন স্বাস্থ্যবান সে ট্রিগার টিপে যুদ্ধ করতে পারবে। কিন্তু তুমি.. এটা মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট অর্থাৎ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট। কাজেই তুমি এটা পারবে। এটা একটা ফ্রন্ট, এটাও একটা কাজ।বিশ্ববাসি জানবে। অনেকের এই সৌভাগ্য বা সুযোগ হয় না। আমাদের সৌভাগ্য যে আমাদের একটা বেতার কেন্দ্র আছে।তাঁদের আমি বললাম, ঠিক আছে আমি থাকতে থাকি কিন্তু পরে কিন্তু আমি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে চলে যাবো। তারপর আমি ওখানে থেকে গেলাম, বিভিন্ন অনুস্ঠানাদি করতে থাকলাম।
বর্তমান প্রজন্ম তো সেই সংগ্রাম, সেই লড়াই- সেটা দেখেনি।তারা তৈরি দেশ পেয়ে গেছে। এবং এই তৈরি দেশ পাওয়া ফলে তাদের বিভিন্ন রকম প্রলোভন – ব্যবসা বানিজ্য, রাজনৈতিককে হাতিয়ার করে নানা রকম সুবিধা অর্জন যেটা অনেকেই করে থাকে।এমবকি তাদেরকে প্রলুব্ধও করা হয়।এটাও একটা ব্যাপার।