রপ্তানিতে ২০২০-২১ অর্থবছরে সর্বাধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রপ্তানি ট্রফি ও সনদ পেয়েছে হা-মীম গ্রুপের প্রতিষ্ঠান রিফাত গার্মেন্টস। বুধবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি প্রধান অতিথি হিসেবে হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদের হাতে এট্রফি তুলে দেন। প্রতিষ্ঠানটি ১৫’বার জাতীয় রপ্তানি ট্রফি জিতেছে। সম্প্রতি রপ্তানি খাতের সার্বিক পরিস্থিতি, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা, পোশাক খাতের চলমান আন্দোলনসহ অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমে সঙ্গে কথা বলেছেন এ কে আজাদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুজয় মহাজন।
নিম্নে সাক্ষাতকারটি তুলে ধরা হল:
প্রশ্ন: আপনি সেরাদের সেরা রপ্তানিকারকের পুরস্কার পেয়েছেন। আপনার প্রতিষ্ঠানের রপ্তানির ভবিষ্যৎ লক্ষ্য কী?
এ কে আজাদ: গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও আমাদের একাধিক প্রতিষ্ঠান সেরা রপ্তানিকারকের স্বীকৃতি পেয়েছে। সরকারের সহযোগিতা সেই সঙ্গে আমাদের সব কর্মীর অবদানে এ অর্জন সম্ভব হয়েছে। তবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বাস্তবতায় গত বছরের তুলনায় বর্তমানে রপ্তানিতে নেতিবাচক ধারা দেখতে পাচ্ছি। গত জুনে সমাপ্ত অর্থবছরে পোশাক খাতে আমাদের রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৭০ কোটি ডলার। আর বস্ত্র খাত তথা টেক্সটাইল খাতে ২০ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরে সেটি কমে পোশাকে ৬০ কোটি ও বস্ত্র খাতে ১৫ কোটি ডলারে দাঁড়াতে পারে। আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে, আগামী তিন বছরের মধ্যে এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলারের রপ্তানির মাইলফলক অর্জন করা। তবে আমরা এটাও বুঝতে পারছি, চলমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত রপ্তানিতে নেতিবাচক ধারা থাকতে পারে।
প্রশ্ন: রপ্তানি খাতসহ দেশের সামগ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি কেমন দেখছেন?
এ কে আজাদ: বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ নানা বিষয় মিলিয়ে সামগ্রিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য এখন চাপের মুখে রয়েছে। আমার প্রতিষ্ঠানের রপ্তানিই ২০ শতাংশের মতো কমে গেছে। করোনার পর ২০২২ সালে রপ্তানিতে আমরা অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি দেখেছি। সবাই তখন ভেবেছিল ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পুরো পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে। বৈশ্বিক মন্দার একটা প্রভাব আমরা দেখতে পাচ্ছি। তার সঙ্গে দেশের অবকাঠামো, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ডলার-সংকট, গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, ব্যবসার খরচ বেড়ে যাওয়া ও চাহিদা কমে যাওয়ায় সামগ্রিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
প্রশ্ন: আমরা দেখছি নিম্নতম মজুরিকে কেন্দ্র করে পোশাক খাতেও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। দেশে-বিদেশে তা কী ধরনের প্রভাব ফেলছে বলে মনে করেন?
এ কে আজাদ: পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের জন্য দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানিবাজার। সে বাজারে শীর্ষে রয়েছে চীন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বড় ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান বুঝতে পেরেছে চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক দীর্ঘ মেয়াদে ভালো যাবে না। তাই অনেক ক্রেতা চীন থেকে ব্যবসা সরিয়ে নিচ্ছিল। এর ফলে বাংলাদেশ কিছু সুবিধা পাওয়া শুরু করেছিল। তবে এখন রাজনৈতিক অস্থিরতা ক্রেতাদের ভাবিয়ে তুলেছে। পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ের শ্রমিক অসন্তোষ ক্রেতাদের ভাবাচ্ছে। শ্রমিকদের এ আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হলে ক্রেতারা তাদের পরবর্তী ক্রয়াদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে চিন্তা করবে। একবার যদি কোনো ক্রয়াদেশ অন্য দেশে চলে যায়, তাহলে তা ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে। তাই এই মুহূর্তে বিদেশি ক্রেতা ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ধরে রাখাকেও জরুরি বলে মনে করি। কারণ, তাদের সামনে অনেক বিকল্প রয়েছে।
প্রশ্ন: যে মজুরি ঘোষণা করা হয়েছে, একজন পোশাকশিল্পের মালিক হিসেবে আপনার কি মনে হয় বাজার বাস্তবতায় তা ঠিক আছে? নাকি সেখানে আরও কিছু করার আছে বা ছিল?
এ কে আজাদ: সাড়ে ১২ হাজার টাকার যে মজুরি বর্তমানে ঘোষণা করা হয়েছে, সেটি এন্ট্রি লেভেলের শ্রমিকদের জন্য। ছয় মাসের শিক্ষানবিশকালে এ বেতন দেওয়া হবে শ্রমিকদের। ছয় মাস পর বেতন হবে আলাদা গ্রেডে। গ্রেডভিত্তিক মজুরি এখনো ঘোষণা করা হয়নি। বিভিন্ন গ্রেডের মজুরি নির্ধারণের পর বোঝা যাবে ওই বেতনে শ্রমিকেরা চলতে পারবে কি পারবে না। শ্রমিকদের শিক্ষানবিশকালের জন্য সাড়ে ১২ হাজার টাকার যে মজুরি ঘোষণা করা হয়েছে, আমি মনে করি তা যথাযথ।
প্রশ্ন: বর্তমানে যে প্রক্রিয়ায় শ্রমিক আন্দোলন দমনের চেষ্টা করা হচ্ছে, সেটি কি সঠিক পথ। এ ক্ষেত্রে অন্য কোনো বিকল্প কি নেই, আপনি কী মনে করেন?
এ কে আজাদ: আমি মনে করি, চলমান এ পরিস্থিতিতে আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করা উচিত। বলপ্রয়োগ করে সব সমস্যার সমাধান হয় না। আমি মনে করি, সব পক্ষের সঙ্গে, বিশেষ করে শ্রমিকনেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একটা সমঝোতায় আসা উচিত। কারণ, এভাবে বিদেশিদের কাছে যে বার্তা যাচ্ছে, তা আমাদের কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না।
প্রশ্ন: দীর্ঘদিন পর রাজনীতিতে আবারও হরতাল-অবরোধ ফিরে এসেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে তার কী ধরনের প্রভাব দেখছেন?
এ কে আজাদ: আমি আগেই বলেছি, ২০২২ সালে আমি যে রপ্তানি করেছি, এ বছর তার চেয়ে ২০ শতাংশ রপ্তানি কমে গেছে। সক্ষমতা অনুযায়ী আমরা উৎপাদন করতে পারছি না। পণ্যের দামও অনেক কমে গেছে। উৎপাদন কমে যাওয়ায় কম দামেও ক্রয়াদেশ নিতে হচ্ছে। এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আমদানিকারক দেশের ওপর নির্ভর করতে হবে। এমন এক পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে ক্রেতাদের কাছে আরও খারাপ বার্তা যাবে। দীর্ঘদিন এ অবস্থা চললে ক্রেতারা বিকল্প খুঁজবে। পাকিস্তানে এখন আমাদের চেয়ে সস্তায় পোশাক পাওয়া যায়। কারণ, তাদের মুদ্রার মান অনেক কম। আবার তাদের নিজস্ব কাপড় ও তুলা আছে। এরই মধ্যে আমাদের অনেক ব্যবসা পাকিস্তানে চলে গেছে। অন্যদিকে, ভারত বেশ কিছু অর্থনৈতিক অঞ্চল করেছে। পাশাপাশি তাদের বেশ কিছু রাজ্য বিনিয়োগকারীদের নানা ধরনের সুবিধা দিচ্ছে। ফলে অনেকে সেখানে বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন। এ বিষয়গুলো আমাদের সবার নজরে আনা উচিত। আমি মনে করি, যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরা অত্যন্ত বিচক্ষণ ও দেশপ্রেমিক। তাই তাঁরা দেশের স্বার্থের কথা আরও গভীরভাবে বিবেচনা করবেন বলে আমি মনে করি।
প্রশ্ন: একজন ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারী হিসেবে বর্তমান পরিস্থিতিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
এ কে আজাদ: এরই মধ্যে আমরা দেখছি, বেকারত্বের হার বাড়তে শুরু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি ৪০ শতাংশ কমে গেছে। শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ৩০ শতাংশের মতো। মূলধনি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়া মানে বিনিয়োগ ও উৎপাদন কমে যাওয়া। পাশাপাশি ডলারের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে স্থানীয় শিল্পমালিকেরা তাঁদের পণ্য বাজারজাত করতে অসুবিধার মুখে পড়েছেন।
প্রশ্ন: আপনি ডলার-সংকটের প্রসঙ্গটি তুলেছেন। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে রপ্তানিকারকেরাই তো সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছেন, তাই নয় কি?
এ কে আজাদ: হ্যাঁ, এ কথা ঠিক, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে আমরা বেশ সুবিধাজনক অবস্থায় আছি। আমদানিকারকদের যে ধরনের সংকটের মুখে পড়তে হচ্ছে, আমাদের তা মোকাবিলা করতে হচ্ছে না। আমরা নিজেরা যেহেতু ডলার আয় করি, তাই আমদানির ক্ষেত্রে আমরা সেই ডলার খরচ করতে পারি। টাকার মান কমে যাওয়ায় আমরা বরং উপকৃতই হচ্ছি। পোশাকের দাম কমে যাওয়ায় যে ক্ষতির মুখে পড়েছিলাম, ডলারের বাড়তি দামের কারণে সে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে। তবে স্থানীয় উৎপাদকেরা খুব অসুবিধায় আছেন। যার প্রভাব দ্রব্যমূল্যের ওপরও আমরা দেখতে পাচ্ছি।
প্রশ্ন: অর্থনীতিতে যে সংকট চলছে, তা মোকাবিলায় যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, সেগুলোকে যথাযথ মনে করেন কি?
এ কে আজাদ: আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ যখন ৪৭ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ৭০০ কোটি ডলার ছিল, তখন আমদানি ছিল ৮ বিলিয়ন বা ৮০০ কোটি ডলারের। এখন আমদানি ৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে চলে এসেছে। এভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণে থাকলে আমার বিশ্বাস, আগামী জুনের মধ্যে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় দিয়ে আমরা একটা স্বস্তিদায়ক অবস্থায় যেতে পারব। সরকারের বর্তমান উদ্যোগ আমাদের স্বস্তিদায়ক অবস্থায় নিয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
প্রশ্ন: আপনি বলছিলেন, দেশে কর্মসংস্থান কমে যাচ্ছে। একজন উদ্যোক্তা হিসেবে বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
এ কে আজাদ: একজন উদ্যোক্তা হিসেবে আমি এ ক্ষেত্রে দুটি সমস্যা দেখছি। একদিকে আমরা দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে পারছি না। অন্যদিকে তরুণ ও মেধাবীদের আমরা কোনো স্বপ্ন দেখাতে পারছি না। তার কারণে দেখছি প্রতিবছর প্রচুর মেধাবী ছেলেমেয়ে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এটা দীর্ঘ মেয়াদে দেশের জন্য ক্ষতিকর। দক্ষ মানবসম্পদের অভাবে কিছু ক্ষেত্রে আমরা বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। এক পরিসংখ্যান থেকে জেনেছি, এ দেশে যত বিদেশি নাগরিক কাজ করছেন, তাঁদের পেছনে বছরে আমাদের ৪ বিলিয়ন বা ৪০০ কোটি ডলার খরচ হচ্ছে। দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে পারলে এবং মেধাবীদের দেশে ধরে রাখতে পারলে বিপুল অর্থ দেশে রাখতে পারব। এত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে কিন্তু দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে পারছি না। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে কর্মসংস্থান খুব বেশি বাড়বে না।
প্রশ্ন: আপনার কাছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যাগুলো কী মনে হয়?
এ কে আজাদ: এ মুহূর্তে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জ্বালানিকে প্রধান সমস্যা বলে মনে হয়। পেট্রোবাংলার কাছ থেকে আমরা শুনছি, পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে গ্যাসের মজুত অনেক কমে যাবে। এখন চাহিদা মেটাতে ২৫ শতাংশ গ্যাস আমদানি করা হয়। প্রতিবছর শিল্পে গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে প্রায় ১১ শতাংশ হারে। নতুন করে গ্যাসের জোগান বাড়াতে না পারলে শিল্পস্থাপন বাধাগ্রস্ত হবে।