রাজধানীর মিরপুরের মধ্য পাইকপাড়ায় মো. ইব্রাহিম নামে এক ব্যক্তি এক সপ্তাহের ব্যবধানে হারিয়েছেন দুই সন্তান। ইব্রাহিমের বাড়ির ঠিকানা জানতে সেখানে যাওয়া হলে চৌরাস্তার মৌড়ে ভ্যানের মধ্যে দোকান বসিয়ে ব্যবসা করা রবিউল ইসলাম জানান, গত কয়েকদিন ধরে কাঁদছেন আর চা বিক্রি করছেন তিনি। ইব্রাহিম তার আত্মীয়-স্বজন না হওয়ার পরও কান্না চলে আসে তার। পরপর দুই শুক্রবার দুই সন্তান হারিয়েছেন ইব্রাহিম। বুধবার (৩০ আগস্ট) রবিউল ইসলামের সঙ্গে ইব্রাহিমের দুই সন্তানের মৃত্যু নিয়ে কথা বলার সময় সেখানে হাজির হন খোরশেদ আলম নামে এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকায় বেকারির দোকানে মালপত্র সাপ্লাই দিয়ে আসছি। গত ১৮ আগস্ট সকালে এসে দেখি লাশবাহী গাড়ি। এর সাতদিন পর ফের একই বাসার সামনে লাশবাহী গাড়ি। হৃদয়টা আমার ভেঙে গেল। চোখের সামনে দুইটা সন্তান শেষ হয়ে গেল।
খোরশেদ আলম আরও বলেন, করোনাভাইরাসের শুরুতে এই পাইকপাড়া এলাকায় একদিন দেখি এক লোক রাস্তায় পড়ে আছে। করোনা আক্রান্ত হওয়ায় কেউ তার কাছে যাচ্ছিল না। আমি একাই ওই লোককে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেছি। কিন্তু আমি তো মরি নাই। আর এখন মশায় মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। গত ১৮ আগস্ট ইব্রাহিম ও রোবেয়া আক্তার দম্পতির ছেলে আরাফাত হোসেন রাউফ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এর সাতদিনের মাথায় ২৫ আগস্ট রাউফের বোন ইসনাত জাহান রাইদা (৭) মারা যায়। ছেলে রাউফের আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর ৯ বছর পূর্ণ হওয়ার কথা ছিল। ছেলের জন্মদিন ঘিরে আয়োজনেরও পরিকল্পনা করেছিলেন মা-বাবা। নানা-নানুসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সিলেট বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ ডেঙ্গুতে এলোমেলো হয়ে গেল এই দম্পতির সাজানো সংসার।
ছেলে রাউফ পাইকপাড়ায় আইকন একাডেমিতে পড়তো, আর তার বোন রাইদা একই প্রতিষ্ঠানে নার্সারিতে ছিল। তারা রাজকন্যা-রাজপুত্র ছিল ইব্রাহিম-রাবেয়ার কাছে। দুই ভাই-বোন সবসময় শুক্রবারের অপেক্ষায় থাকতো। শুক্রবার মা-বাবা তাদের চিড়িয়াখানা, শিশু পার্ক, চন্দ্রিমা উদ্যানসহ নানা জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যাবে। রেস্টুরেন্টে রকমারি খাবার খাবে। কিন্তু সেই শুক্রবার এখন ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ হয়ে গেল মা-বাবার কাছে। বাবা ইব্রাহিম একটি তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠানে পরিবহন শাখায় চাকরি করেন। পাশাপাশি রেন্ট-এ-কারের ব্যবসা রয়েছে তার। আর স্ত্রী রাবেয়া একজন গৃহিনী। ইব্রাহিম বলেন, আমার সবকিছু শেষ। কিছু বুঝে উঠার আগেই রাজপুত্র আর রাজকন্যাকে আমরা হারালাম। ভাগ্যকে দোষ দেয়া ছাড়া আর কী বলব। কত স্বপ্ন ছিল। সাধ্য অনুযায়ী সন্তানদের সব শখ পূরণের চেষ্টা করেছি। কয়েকদিন আগে প্রাইভেটকারও কিনেছিলাম। ওরা দুই ভাই-বোন একসঙ্গে গাড়িতে করে নিজেদের স্কুলে যাবে বলে।
ইব্রাহিম আরও বলেন, আমি আগে মাঝে মাঝে মোটরসাইকেলে স্কুলে দিয়ে আসতাম ওদের। কখনো কখনো রিকশায় যেত। এখন এই গাড়িতে (প্রাইভেটকার) কে চড়বে। ঘরের মধ্যে ওদের স্মৃতিচিহ্ন। যে ঘরে ওদের পায়ের চিহ্ন পড়বে না, সেখানে আমাদের পক্ষে বসবাস করা সম্ভব নয়। সেপ্টেম্বর থেকে আমরা বাসা ছেড়ে দিয়েছি। ইব্রাহিম জানান, গত ১৬ আগস্ট প্রথমে ছেলের হালকা জ্বর শুরু হয়। পরে স্থানীয় এক ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর ডেঙ্গু পরীক্ষার কথা বলেন। ওই দিন রক্ত পরীক্ষা করা হলে পরদিন ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। এরপর ওই চিকিৎসক বাসায় চিকিৎসা দেয়ার পরামর্শ দেন। ১৮ আগস্ট ছেলে পেটব্যথার কথা বলে। এরপর ওইদিন ফের ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো হয়। প্রথম পরীক্ষায় প্লাটিলেট ১ লাখ ৬২ হাজার ছিল। দ্বিতীয় পরীক্ষায় ১৫ হাজারে নেমে আসে। ১৮ আগস্ট সন্ধ্যায় মিরপুরের ডেলটা হাসপাতালে ছেলেকে নেয়ার পর চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করে রাউফকে। ছেলে হাসপাতালে যাওয়ার আগে শুধু বলছিল, বাবাকে ডাক দাও, আমার পেটব্যথা করছে। ছেলে রাউফের লাশ ঢাকার সাভারের হেমায়েতপুরে দাফন করা হয়। যদিও ইব্রাহিমের গ্রামের বাড়ি ভোলা। ছেলে মারা যাওয়ার রাতেই মেয়ে রাইদার গায়ে জ্বর আসে। ওই রাতে ঢাকায় ফিরে ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো হয় রাইদার। পরদিন ডেঙ্গু পজিটিভ আসে মেয়ের। ডেল্টা ও ইবনে সিনা হাসপাতাল ঘুরে সিট না পেয়ে এক দালালের মাধ্যমে ১৯ আগস্ট ধানমন্ডির রেনেসাঁ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় মেয়েকে।
ইব্রাহিমের অভিযোগ, রেনেসাঁ হাসপাতালে পাঁচ দিন রাখা হলেও সঠিকভাবে চিকিৎসা দেয়া হয়নি মেয়ে রাইদার। সুস্থ হয়েছে জানিয়ে ২৪ আগস্ট রাইদাকে বাসায় নেয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসক। বাসায় ফেরার পর আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলে নানা সমস্যা ধরা পড়ে। পরে মেয়েকে ওইদিন মহাখালীর ইউনিভার্সেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পিআইইউসিতে রেখে চিকিৎসা দেয়া হয়। দামি সব ইনজেকশন দেয়া হয়। কিন্তু কোনো কিছুতেই মেয়েকে বাঁচানো যায়নি। ২৫ আগস্ট সকালে মেয়েও না ফেরার দেশে চলে গেল।