মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি-হিলারির আমলে চীন ও আমেরিকার সুসম্পর্ক বজায় ছিল। কিন্তু ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর সেই সম্পর্কে অবনতি ঘটে। কারণ ট্রাম্প একজন ব্যবসায়ী এবং তার চোখের সামনে চীন বামের লাল বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এর মাধ্যমে পৃথিবীর সিংহভাগ ব্যবসা নিজের করে নিতে শুরু করে। তাই ট্রাম্প প্রকাশ্যে চীনের বিপরীতে দাঁড়ান। শুরু করেন নতুন ফরেন পলিসি ফ্রি এন্ড এপেন ইন্দ-প্যাসিফিক।

এমনকি তার মেয়াদের একদম শেষের দিকে ‘২০ সালের নভেম্বরে পর্যন্ত তার প্রতিনিধি বাংলাদেশে এসে এতে যোগদান করার ব্যাপারে আমাদের অনুরোধ করেছিল। আমরা এড়িয়ে গেছি। কারণ আমরা ইতোমধ্যে চায়নার সাথে বেল্ট অ্যান্ড রোডে চুক্তিবদ্ধ।বিপরীতে অ্যামেরিকার ইন্দো-প্যাসিফিক চুক্তি দক্ষিণ চীন সাগর থেকে শুরু করে পূর্ব এশিয়া-দক্ষিণ এশিয়ার পুরো জায়গায় আমেরিকার উপস্থিতি ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করছে। এটি অস্ট্রেলিয়া থেকে শুরু করে জাপান-কোরিয়াসহ থাইল্যান্ড, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম পর্যন্ত বিস্তৃত।
আমেরিকা এখানে কৌশলগতভাবে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জকে রেখেছে ঠিক যেখানে প্রায় আশি বছর পূর্বে পার্ল হারবারে জাপানি বোমা হামলা হয়েছিল এবং এর মাধ্যমে আমেরিকা জড়িয়ে পড়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। ভৌগোলিক কৌশলগত এই জায়গাটা আমেরিকার একটি আউটপোস্ট এশিয়ার দিক থেকে যেকোনো ধরনের আক্রমণ ঠেকানোর জন্য তারা সেখানে এই আউটপোস্ট ধরে রেখেছে।

বহুদিন ধরে তারা ভারত সাগর এবং বঙ্গোপসাগরে একটা ঘাঁটি করার চিন্তা করছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সফল হতে পারে নি। ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি পেপার এর শুরুটা করে দিয়েছে। ট্রাম্পের রিপাবলিকান গভমেন্টের হাতে এর শুরু হলেও ডেমোক্র্যাট জো বাইডেন এটা পুরোপুরিভাবে অনুমোদন করেছে। এইবেলা এদের মাঝে কোনো বিরোধ নাই। ২০২১ সালে বাইডেন ওপেনলি বলেছেন যে, পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকার ওপর। কারণটা বুঝতেই পারছেন, আগামীতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তার কঠিনতম আঘাতগুলো মাত্র দুইটা ফ্রন্টে আসবে। যার একটা অলরেডি ইউক্রেনে শুরু হয়ে গিয়েছে। আরেকটা এই ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে অবস্থিত, যেখানে বাংলাদেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে।

আমেরিকা খুব ভালোভাবে জানে যে তাকে আঘাত করার ক্ষমতা একমাত্র এশিয়ার রয়েছে, যেটা দেখা গিয়েছিল পার্ল হারবারে। তাই এবার তারা এই ব্যাপারে খুবই কেয়ারফুল। চায়না আমেরিকার এই ইন্দো-প্যাসি উদ্যোগকে ভালোভাবে দেখছো না। তারা বলেছে উত্তর আটলান্টিকে ন্যাটো যা করেছে এবং করছে সেটাই পশ্চিমারা ইন্দো-প্যাসিফিকের মাধ্যমে এই অঞ্চলে করতে চায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্নায়ুযুদ্ধকালীন সমাজতন্ত্রের হাতে পূর্ব ইউরোপের পার্বত্য বলকান অঞ্চল হারানোর পর মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রণ হাতে রাখতে অ্যামেরিকা যেমন ইসরাইলকে শক্তভাবে সেখানে বসিয়েছিল, যেমন পূর্ব এশিয়ায় কমিউনিস্ট প্রভাব থামানোর জন্য এসোসিয়েশন অফ সাউথ ইস্ট এশিয়ান নেশনস গঠনে পুরো সহায়তা করেছিল আমেরিকা, তেমনই আমেরিকা বর্তমানে ইন্দো-প্যাসিফিকে প্রচুর ভৌত অবকাঠামো তৈরিতে সহায়তা করছে, ঋণ দিচ্ছে।

বাংলাদেশের সাথে অ্যামেরিকার অর্থনৈতিক সম্পর্ক বর্তমানে খুবই ভালো। আমেরিকা এখানে প্রচুর ফান্ডিং করে যা ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট আকারে আসে কিংবা নন স্টেইট অ্যাক্টর ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এর হাত ধরে আসে। এছাড়া তারা নিজেদের গণতান্ত্রিক আইডিওলজি, মানবাধিকার, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্যে ইন্সটিটিউশনাল স্ট্রেন্দেনিংয়ে সহায়তা করে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমাদের সর্বোচ্চ অর্থায়ন করে, সেই দেশের সংসদের নিম্নকক্ষ হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ এর মাধ্যমে লবিং চালু রাখে, আমেরিকার দূত ভিক্টোরিয়া নোলান বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিকে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানায়।

তাহলে আমেরিকা মাঝে মাঝে বাংলাদেশে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার ডাক দেয়, খুন-গুম, মানবাধিকারের কথা বলে কেন? কারণ এর মাধ্যমে তারা সামরিক আগ্রাসনের গ্রাউন্ড তৈরি করে রাখে। যেটাকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভাষায় আরটুপি বা রেসপনসিবিলিটি টু প্রটেক্ট বলা হয়। এটাকে আগে মানবিক হস্তক্ষেপ বা হিউম্যানিটারিয়ান ইন্টারভেনশন বলা হতো। জাতিসংঘের ভাষায় জাতিসংঘের সনদের একান্ন নাম্বার আর্টিকেল ও সপ্তম চ্যাপ্টারে রাষ্ট্রীয় সশস্ত্রপন্থার কথা বিবৃত হয়েছে। আর্টিকেল ৫১-এ বলা আছে যে, রাষ্ট্র নিজের আত্মরক্ষার্থে অন্য রাষ্ট্রকে সশস্ত্র আক্রমণ করতে পারবে, যেটি পরবর্তীতে অন্য দেশের হাতে নিউক্লিয়ার বা রাসায়নিক অস্ত্র আছে মর্মে আক্রমণে ব্যবহৃত হয়েছে। আবার অন্য রাষ্ট্র জঙ্গীবাদে সমর্থন দিচ্ছে মর্মেও সেখানে আক্রমণ করতে দেখা গেছে। যেমন ইরাক ও আফগানিস্তান। এছাড়া আত্মরক্ষার কথা বলে ‘৭৮ সালে কম্বোডিয়ায় ভিয়েতনামের আক্রমণ, অ্যাঙ্গোলায় তানজানিয়ার আক্রমণ এবং ‘৭১ সালে পাকিস্তানে ভারতের আক্রমণ লক্ষ্য করা গিয়েছে।
আরেকটি উপায়ে রাষ্ট্রের সশস্ত্র আক্রমণ জায়েজ আছে। জাতিসংঘ সনদের সাত নম্বর চ্যাপ্টারে শান্তির প্রতি হুমকি বা আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা ভঙ্গ বা আগ্রাসনের কথা উল্লেখিত আছে যেগুলোর বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমতিক্রমে এক বা একাধিক রাষ্ট্র একযোগে সশস্ত্র পন্থা অবলম্বন করতে পারে।
তবে নিরাপত্তা পরিষদ একমত না হলে বা মানবিক বিপর্যয়ের জন্য উভয় রাষ্ট্র দায়ী হলে সেখানে মানবিক হস্তক্ষেপের নামে সামরিক অভিযান চালানো যাবে কি না, সে ব্যাপারটা এখনও বিতর্কিত। জাতিসংঘ সনদে এগুলো নিয়ে স্পষ্টভাবে কিছু বলা নেই। দুঃখজনকভাবে নিরাপত্তা পরিষদের মানবিক হস্তক্ষেপ পরপর তিনবার ব্যর্থ হয়। প্রথমটা ‘৯৩ সালে সোমালিয়ায়, পরে ‘৯৪ সালে রুয়ান্ডায় এবং এরপর ‘৯৫ সালে বসনিয়া-হার্জেগোভিনায়। সেখানে জাতিসংঘের চোখের সামনে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত হয়। কেউ কিছু করতে পারেনি।
নিরাপত্তা পরিষদও অপারেশন চালানোর ক্ষেত্রে নিজেদের স্বার্থ দেখে। ১৯৯৯ সালে পূর্ব তিমুরে অস্ট্রেলিয়ার অভিযান বা সিয়েরা লিওনের অভিযানের পিছনে তেল ও ব্লাড ডায়মন্ডের ভূমিকা ছিল বৈকি!
জাতিসংঘ সনদের পাঁচটি দুর্বলতা রয়েছেঃ
প্রথমত, ভেটো।
দ্বিতীয়তঃ একদিকে রাষ্ট্রসমূহের নিরাপত্তা বা রিয়েলিস্ট প্রিন্সিপালকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আরেক দিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে কো-অপারেশন বা লিবারাল প্রিন্সিপালকে।
তৃতীয়ত, জাতিসংঘের সনদের শুরুতে উই দ্যা পিপল অফ ইউনাটেড নেশনস মানে জনতাকে প্রকাশ করা হয়েছে, আবার নিরাপত্তা পরিষদের রেফারেন্স হিসেবে আছে মানুষ নয় রাষ্ট্র।
চতুর্থত, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব দেয়া হয়েছে অপরদিকে সামরিক হস্তক্ষেপের কথাও বলা হয়েছে।
সর্বশেষ, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কাজ করে রাষ্ট্রকে নিয়ে কিন্তু এর বিভিন্ন এজেন্সি যেমন, ইউনেস্কো কাজ করে ব্যক্তিকে নিয়ে।

নিরাপত্তা পরিষদের সমর্থন ছাড়াও সামরিক আগ্রাসন চালানো যায়। জাতিসংঘে জরুরি সভা আহ্বান করে যদি সাধারণ পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশ রাষ্ট্রের একমত হয় তবে সামরিক অভিযান পরিচালনা করা যায় যেটা আমরা দেখেছি ‘৫০ সালে কোরিয়ান যুদ্ধের সময় যখন উত্তর কোরিয়ার পক্ষে রাশিয়া ভেটো দিচ্ছিলো, তখন জাতিসংঘের সদস্যরা মিলে শান্তির জন্য সংহতি ঘোষণা করে যুদ্ধবিরতি জারি করে। এছাড়া আমরা এটি দেখেছি ‘৫৬ সালের সুয়েজ ক্রাইসিসে। তখন এর মাধ্যমে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরাইলকে মধ্যপ্রাচ্যে মিশরের বিরুদ্ধে থামানো হয়েছিল। ২০০৩ সালে প্যালেস্টাইনে ইসরাইলের দেয়াল নির্মাণে এর মাধ্যমে বাঁধা দেয়া হয়েছিল। ‘৯৯ সালে যখন সাবেক যুগোস্লাভিয়ার অন্তর্ভুক্ত সার্বিয়া কসোভোতে আগ্রাসন চালানো শুরু করে, তখন ন্যাটো দ্রুত সেখানে আক্রমণ করে সার্বিয়াকে হটিয়ে দেয়।

কাজটা নিরাপত্তা পরিষদ নিজে না করে ন্যাটো করায় তা সঠিক হলো কিনা, এটি নিয়ে যখন ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে ন্যাটোভুক্ত দশটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সাবেক যুগোস্লাভিয়া মামলা করে, তখন বেলজিয়াম তাদের আইনগত অবস্থান জানায়, আমেরিকা নিরাপত্তা পরিষদের দোহাই দেয় ; স্পেন, ইংল্যান্ড, জার্মানি ও নেদারল্যান্ড বলে যে কসোভোতে মানবিক বিপর্যয় হয়েছিল, সেখানে তারা চুপ থাকতে পারেনি এবং পর্তুগাল, ফ্রান্স, ইটালি ও কানাডা কিছু না বলে চুপচাপ থাকে।টেকনিক্যাল কারণে রায় ন্যাটোর পক্ষে যায় কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই বিতর্কে সমাধান হয়নি যে আসলেই এভাবে সিকিউরিটি কাউন্সিল সশস্ত্র উদ্যোগ না নিয়ে ন্যাটোর আক্রমণ করার সঠিক হলো কিনা। বিষয়টিকে ‘অবৈধ কিন্তু ন্যায্য’ ভাবে দেখা হয়। অর্থাৎ ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য তারা গিয়েছিল। আসলে এটা ছিল এক নতুন প্রেক্ষাপট রচনার উপলক্ষ্য মাত্র। কারণ এর পর ন্যাটোর শক্তি-সামর্থ্য দেখে একযোগে পূর্ব ইউরোপের দশটি রাষ্ট্র ন্যাটোতে যোগ দেয়, হ্যাঁ, আজকের পুতিন যেই উছিলায় ইউক্রেনে আক্রমণ করলেন, এর সুত্রপাত এখানেই। ‘১৪ সালে ক্রিমিয়াকে অধিগ্রহণের সময় পর্যন্ত রাশিয়া ‘৯৯ সালের কসোভো আক্রমণের উদাহরণ দিয়েছিল।

২০০৫ সালে জাতিসংঘের সম্মেলনে কসোভোতে ন্যাটোর এই বিশেষ আক্রমণের স্টাইল বা আরটুপি-কে জায়েজ করে নেয়া হয়। কিন্তু সেখানে নিরাপত্তা পরিষদ কোনো ফোর্স দ্বারা আরটুপি-তে রাজি না হলে কি হবে, সেটা খুব সতর্কভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়। এই ক্রাইসিসটা দেখা দেয় ২০১১ সালে সিরিয়ায় পশ্চিমা আগ্রাসনের প্রেক্ষাপট তৈরির পরিপ্রেক্ষিতে। তখন চীন ও রাশিয়া সিরিয়ার পক্ষে একের পর এক ভেটো দেয়। ২০০৫ সালে জাতিসংঘে আরটুপি জায়েজ করার পর ‘০৬ সালে সুদানের দারফুরে আমরা সামরিক আরটুপি চালাতে দেখেছি, ‘১১ সালে লিবিয়ায় আক্রমণ চালিয়েছে ন্যাটো, এছাড়া ওই বছর দক্ষিণ সুদান ও ইয়ামেনে আক্রমণ চালানো হয়েছে, ‘১৩ সালে মালিতে ও ‘১৪ সালে আইভরি কোস্টে আক্রমণ করেছে ফ্রান্স। বিষয়টাকে নিরাপত্তা পরিষদ ইতিবাচকভাবে দেখলে পরবর্তীতে এটা নিয়ে অনেক বিতর্ক সৃষ্টি হয়। কারণ ‘১১ সালে লিবিয়ায় গাদ্দাফিকে ন্যাটোর আক্রমণ যত না ছিল মানবিক হস্তক্ষেপের ব্যাপার, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল সরকার পরিবর্তনের প্রচেষ্টা। ‘১১ সালে লিবিয়ায় আরটুপি চালানো সহজ ছিল। কারণ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাশাপাশি সেখানে ওআইসি, আরবলীগ, আফ্রিকান ইউনিয়ন প্রভৃতি মুসলিম-প্রধান সংগঠন একে সমর্থন করেছিল। একইভাবে ‘১৪ সালে আইভরিকোস্টের ঘটনায় বলা হয়েছিল যে, লিবিয়ার মতো আইভরিকোস্টের সরকারও জনতাকে নিরাপত্তা দিতে পারছেনা। তাই সেখানে অপারেশন চালাতে হবে।

চারটি ক্ষেত্রে সামরিক আরটুপি এর গ্রাউন্ড প্রস্তুত হয়ঃ
মানবতাবিরোধী অপরাধ, আগ্রাসন, যুদ্ধাপরাধ ও জেনোসাইডের দায় থাকলে। মাত্র কয়েক দিন আগে অ্যামেরিকা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের উপর জেনোসাইডের স্বীকৃতি কেন দিলো? কেন তারা উইঘুরের মুসলিমদের মানবাধিকার নিয়ে এতো চিন্তিত? কারণ তারা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আরটুপি এর গ্রাউন্ড তৈরি করতে চায়। এর সাথে মানবাধিকারের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। কারণ আমরা পশ্চিমা মানবাধিকারের চরম রূপ দেখেছি ইরাকে, সিরিয়ায় এমনকি আফগানিস্তানেও। আমেরিকার গুয়ান্তানামো বে-র কারাগারে যেভাবে মানুষকে নির্যাতন-নিপীড়ন করা হয়েছে, তা মানব ইতিহাসের কালো অধ্যায় হিসেবে আজীবন বিবেচিত হতে থাকবে। আরটুপি স্টাইল একাধিক রাষ্ট্র তাদের সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে সম্মিলিত আক্রমণ চালাতে পারে, যেটা দেখা গিয়েছিল লিবিয়ায়। তবে তারা সিরিয়ায় সফল হতে পারেনি। বারবার সেখানে বাশার আল-আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর কথা বললেও চায়না ও রাশিয়ার উপর্যুপরি ভেটোর কারণে নিরাপত্তা পরিষদে তা আটকে গিয়েছে। এখন মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের পক্ষ নিয়ে অ্যামেরিকা এই ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আরটুপি এর গ্রাউন্ড প্রস্তুত করলো।

রোহিঙ্গা ক্রাইসিসের শুরুটা মিয়ানমারে সামরিক সরকার আসার মাধ্যমে। সামরিক সরকারের জনসমর্থন থাকে না বিধায় জনসমর্থন অর্জনের জন্য তারা ধর্ম বা জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করে। এই ঘটনা দেখা গিয়েছে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের আমলে। তারা বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদকে প্রমোট করেছে; ‘৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন দিয়ে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, ‘৯০ সালের সাদা আইডেন্টিটি কার্ড চালুর মাধ্যমে আবারও তাদের পৃথক করেছে। এমনকি, ‘১৫ সালে সেই আইডেন্টিটি কার্ডও বাতিল করেছে, যদিও তারা ‘০৮ সালের নির্বাচনে ভোট দিয়েছিল। কোন রাষ্ট্র ধর্ম বা জাতীয়তাবাদের দিকে একবার ঢুকে পড়লে সেখান থেকে ফিরে আসা খুবই কঠিন। অং সান সুচি গণতান্ত্রিক হলেও বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ থেকে ফিরতে পারেননি।

বর্তমানে মিয়ানমারের সাথে চায়না, রাশিয়া এবং ভারতের সম্পর্ক খুবই ভালো। মিয়ানমারের সাথে চায়নার বিশাল বর্ডার আছে। মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়া থেকে সমুদ্রপথে আমদানিকৃত তেল মিয়ানমারের একটি প্রদেশে স্টোর করে পরে পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনে পাঠানো হয়।এছাড়া, সাগর থেকে গ্যাস উত্তোলন করে তাও পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনে পাঠানো হয়। তাদের অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য চীন প্রচুর অর্থায়ন করে। ঐতিহাসিকভাবেও এরা সুসম্পর্কে আবদ্ধ। ‘৪৯ সালে যখন মেইনল্যান্ড চায়না থেকে রিপাবলিক অফ চায়নার অ্যামেরিকাপন্থি নেতারা পালিয়ে যায়, তখন তাদের কিছু নেতা মিয়ানমারে আশ্রয় নিয়েছিল। মিয়ানমার তাদের গ্রেপ্তার করে মাও সে তুংয়ের পিপলস রিপাবলিক অফ চায়নায় ফেরত পাঠিয়েছিল। চায়নার সব বাণিজ্য এখন ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মধ্যবর্তী মালাক্কা প্রণালী হয়ে যায়। এই রাস্তাটা কোনো ভাবে বন্ধ করে দিলে চায়নার বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়বে। তাই চীন অল্টারনেটিভ রুট হিসেবে সড়কে মিয়ানমার হয়ে ভারত মহাসাগর-বঙ্গোপসাগর দিয়ে বাণিজ্যের পরিকল্পনা করছে। এর মাধ্যমে সে ভারতের উপরও নজরদারি করতে পারবে। রাশিয়ার সাথেও মিয়ানমারের সম্পর্ক খুবই ভালো। এটি বর্তমানে ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর প্রভৃতির সাথে ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কে আবদ্ধ। রাশিয়ায় মিয়ানমারের সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আসলে মিয়ানমার সেই ‘৬৪ সালে বামপন্থি চীন ও রাশিয়ার ভেঙে যাওয়া সম্পর্ককে জোড়া লাগানোর সেতু হিসেবে কাজ করছে, ঠিক যেমন মুক্তিযুদ্ধকালীন আমেরিকা ও চায়নার সম্পর্কোন্নয়নের সেতু হিসেবে কাজ করেছিল পাকিস্তান। ভারতের সাথেও মিয়ানমারের বর্তমান সম্পর্ক ভালো। কারণ ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সেভেন সিস্টার্স রাষ্ট্রসমূহকে তারা মিয়ানমার-মিজোরাম-আসাম-শিলিগুড়ির মাধ্যমে যুক্ত করে হাইওয়ে কানেক্টিভিটিতে আনতে চায়। এছাড়া কলকাতা-মিয়ানমার হয়ে মিজোরামে আরেকটি সামুদ্রিক রুট তৈরীর চেষ্টা করছে ভারত। কারণ এখন পর্যন্ত সেভেন সিস্টার্স এ যেতে হলে ভারতকে হয় বাংলাদেশের উপরের সরু চিকেন নেক অতিক্রম করে যেতে হয়, অথবা বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, যা স্পষ্টতই ভারতের নিরাপত্তার সাথে জড়িত। ভারতকে তাই আমেরিকা পুরাপুরি বিশ্বাস করে না কারণ রিজিওনাল পলিটিক্সে ভারত চায়নার বিপরীতে কাজ করলেও গ্লোবাল পলিটিকাল থিয়েটারে সেটা পূর্বদিকের রাশিয়া এবং চায়নাকে সমর্থন করে। এ কারণে ইন্ডিয়ার সাথে অ্যামেরিকার কোয়াড চুক্তি থাকলেও আমেরিকা সেখানে আলাদা করে চুক্তি করে পারমাণবিক শক্তিসমৃদ্ধ ইংল্যান্ডকে ডেকে এনেছে এবং অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব সীমান্তে পারমাণবিক সাবমেরিন ঘাঁটি নির্মাণ করছে। অর্থাৎ কোনো কারণে ভারতের সাথে সামরিক কোয়াড চুক্তি কাজ না করলেও তারা ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলের অপারেশন চালাতে পারবে।

এই মুহূর্তে আমেরিকা চাইছে বাংলাদেশ যেন তাদের সাথে দুটি অস্ত্র কেনার চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। একটি জেনারেল সিকিউরিটি অফ মিলিটারি ইনফরমেশন এগ্রিমেন্ট আরেকটি অ্যাকুইজিশন ক্রস-সার্ভিসিং এগ্রিমেন্ট। আমেরিকার চাইছে বাংলাদেশে এই ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে তার শক্ত সহযোগী হয়ে উঠুক। তাহলে এই অঞ্চলে ভবিষ্যতে চায়নার উত্থান ঠেকানো যাবে। আমেরিকা মূলত বাংলাদেশে একটা স্ট্রংহোল্ড চাচ্ছে যেন আগামীতে সামরিক প্রয়োজনে ভারত চীন ও রাশিয়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় এবং আরটুপি এর নামে সামরিক আগ্রাসন পরিচালনা করা যায়, ঠিক যেভাবে তারা মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের সাথে চিরস্থায়ী বন্ধুত্বের সম্পর্কে আবদ্ধ। বাংলাদেশ এখন কী করবে? বাংলাদেশ এখন কোন পক্ষে যাবে এটা নির্ভর করছে আপনার, আমার এবং আমাদের সম্মিলিত জনমতের উপর।

লেখক : অনিন্দ মাহবুব

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে