বাংলাদেশ ঘূর্ণিঝড় প্রবণ দেশ এটা এখন আমরা সকলেই কম বেশি জানি। আর ঘুর্ণিঝড়ের তান্ডব যে কি হতে পারে তা উপকুলীয় অঞ্চলের মানুষ ভালো ভাবেই জানেন। এ আঘাতে প্রণ ওসম্পদের ক্ষতি হতে দেখেছে বাংলাদেশ আর সেই ক্ষতি থেকে আমাদের ঘুরে দাড়াতে বছরের পর বছর লেগেছে, লেগেছে দেশীয় বৈদেশিক সাহায্য। এক একটি ঘূর্ণি ঝড়ের ১০ বছর পরেও আমাদের রিপোর্ট করতে হয় “আজ ও ঘুরে দাড়াতে পারেনি ঘূর্ণিঝড় দূর্গত .. এলাকার মানুষ” বা “এখনও সংস্খার হয়নি ঘুর্লিঝড়ে বিদ্ধস্ত বেড়ী বাঁধ”।এরকম নানা শিরনামে। এই যখন পরিস্থিতি তখন প্রশ্ন উঠতে পারে এ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কি ? একটি সরল বাক্যের প্রশ্ন কিন্তু উত্তর অনেক কঠিন। প্রকৃতিক দূর্যোগ কে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা যা পারি তাহল সচেতনতা বাড়িয়ে ঘুর্ণিঝড়ের মত দূর্যোগের হাত থেকে প্রাণ ও সম্পদহানী কমাতে বা রক্ষা করতে। একন্য আমাদে দেশে দূর্যোগকালীন সময়ে করণীয় বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অনেক কাজ হয়েছে এবং হচ্ছে। তবে জনসচেতনতা বেড়েছে ভেবে আমাদের আত্মতুষ্টির কোন কারণ নেই।
উপকুলিয় অঞ্চলে আমার বসবাস এবং এ অঞ্চলেই সাংবাদিকতা করি তাই নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই কিছু বলতে চাই যদি কারো উপকারে আসে । যখনই সাগরে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয় তখনই আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে সংকেত জারী করা হয় । সতর্কতা সংকেত ১, ২ থেকে এই অনেক সময়ে আমদের ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতও পেয়ে থাকি। কিন্তু উপকুলের মানুষ সহ আমরা অধিকাংশ মানুষই জানিনা কোন সতর্কবার্তা কি করা উচিত। ফলে প্রতিবারই দূর্যোগে আমাদের সম্পদের ক্ষতি ও প্রাণহানী ধারনার তুলনায় বেশী হয়, যা সকলের জন্য বেদনা দায়ক। তবে একটি কথা বলতেই হয় পূর্বের তুলনায় সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো অনেক বেশি সক্রিয় এবং কত মানুষ ও প্রাণীকে আমরা দূর্যোগকালীন সময়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ও নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে আনতে পানি এ নিয়ে অনেক বড় কাজ হয়েছে। এখন আমাদের সচেতন হওয়ার মাত্রাটা আর একটু বাড়াতে পারলে আমেদেরই লাভ।
সকলের জ্ঞাতার্থে সংক্ষপে একটু ঘূর্ণিঝড় সংকেত ও ব্যাখ্যা তুলে ধরার চেষ্টা করছি, যদি উপকারে আসে।
১ নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত: এই সংেকেত জারী হলে বুঝতে হতে দূর সমুদ্রে অল্পসময়ের জন্য প্রচন্ড ঝড়ো হাওয়া বইছে যা ঝড়ে পরিণত হতে পারে। এক্ষেত্রে ঐ স্থানে বাতাসের গতিবেগ ঘন্টায় ৫১ থেকে ৬১ কিলোমিটারের মধ্যে থাকে এবং এই সংকেতটি সমুদ্রগামী বা সমুদ্রে অবস্থিত যানবাহনের জন্য ব্যবহৃত হয়।
২ নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেতঃ এই সংকেত দিলে বুঝতে হতে দূর সমুদ্রে ঝড়ের সৃষ্টি হয়েছে। এসময় ঐ এলাকায় বাতাসের গতিবেগ ৬২ থেকে ৮৮ কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে। এই সংকেতটিও গভীর সমুদ্রের জন্য ব্যববহৃত হয়।
৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেতঃ নদী ও সমুদ্র বন্দরে দমকা হওয়ার আশংকা রয়েছে। এসময় বন্দর ও বন্দরের আশ পাশের এলাকায় ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার বেগে ঝড়ো হওয়া বয়ে যেতে পারে।
৪ নম্বর হুশিয়ারী সংকেত: এর ফলে বন্দর ও বন্দরের আশ পাশের এলাকায় ৫১-৬১ কিলোমিটার বেগে ঝড়ো হওয়া বয়ে যেতে পারে। তবে বিপদের আশংকা এমন নয় যে চরম নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহন অর্থাৎ বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে হবে। তবে অবশ্যই ক্ষয়-ক্ষতি রোধে সতর্কতা অবলম্বর করতে হবে।
৬ নম্বর বিপদ সংকেতঃ এই বিপদ সংকেত ঘোষনা করা হলে বুঝতে হবে বন্দর সংলগ্ন এলাকায় মাঝরী তীব্রতা সম্পন্ন সামুদ্রিক ঘুর্ণিঝড় বিরাজ করছে যার বাতাসের গতিবেগ ৬২ থেকে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত।
৮ নম্বর মহা বিপদ সংকেতঃ এ সময় প্রচন্ড তীব্রতা সম্পন্ন সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কারলে বন্দরে তীব্র ঝড়ো আবহাওয়া বিরাজ করচে। প্রচন্ড এ ঘূণিঝড়ে বাতাসের তীব্রতা ঘন্টা ৮৯ থেকে ১১৭ কিলোমিটার হতে পারে। এ পরিস্থিি বিরাজ করলে সাধারণত অতিরিক্ত সর্তকতা অবলম্বর করা হয় এবং বন্দরের সকল পণ্য উঠানামা বন্ধ রাখা হয় পাশাপাশি বন্দরের কাছে থাকা জাহাগ গুলিকে নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়া হয় বা নেওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।
৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেতঃ এই সংকেত দিলে বুঝতে হবে যে ঝড়টি আসছে সেটি প্রচন্ড তীব্রতা সম্পন্ন একটি সামুদ্রিক ঝড়। এসময় এই ঝড়ের কেন্দ্র ও আশ পাশে বাতাসের গতিবেব ঘন্টায় ১১৮ থেকে ১৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে যা একটি হারিকেনে রূপনিয়েছে। এসময় বন্দর ও আশ পাশের এলাকায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দেয়া হয়। প্রান ও প্রণী সম্পদ রক্ষায় মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার জন্যও বলা হয়।
১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতঃ এই সংকেতের অর্থ হচ্ছে যে ঝড়ে বন্দর বা উপকুল আক্রান্ত হতে চলেছে সেটি একটি প্রচন্ড তীব্রতা সম্পন্ন বা সুপার সাইক্লোন। এর ফলে বন্দর বা যে স্থান থেকে এটি অতিবাহিত হবে সেখানকার বাতাসের সর্বনি¤œ গতিবেগ থাকবে ১৭১ কিলোমিটার প্রতিঘন্টায়। বাতাসের এই তীব্রতা আরও বাগতে পারে যার কোন সীমা নেই। এসময় জনগনে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় এবং দূর্যোগ সহায়তা, উদ্ধারকারী দল ও ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনাকারীদের প্রস্তুত রাখা হয় ।
একটু যদি খেয়ালা করেন দেখবেন সংখার ক্রমানুশারে ৫ ও ৭ নম্বর সংকেতকে বাদ রেখেছি। এরও কারন রয়েছে। আমাদের দেশের প্রস্তাবিত নতুন ঘুর্ণিঝড় সংকেত ব্যবস্থায় ৫ ও ৭ নম্বর সংকেতকে না রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। সেখানে ৪ এর পর ৬ এবং ৬ এর পরে ৮ নম্বর বিপদ সংকেতের ব্যবহার করার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে।
আপনারা বলতেই পারেন ১ থেকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত তো শেষ। নতুন করে আবার ১১ নম্বর বিপদ সংকেত এলো কথা থেকে। যেহেতু এই বিপদ সংকেতটি সাধারণত ব্যবহার করা হয় না তাই আমরা অধিকাংশ মানুষ এটি জানিনা। ১১ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারী করা হলে বুঝতে হবে আবহাওয়ার হুশিয়ারি কেন্দ্রের সঙ্গে সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এ অবস্থায় স্থানীয় কর্মকর্তা ও জনগনকে মনে করতে হবে যে প্রলয়ঙ্করী ঘুর্ণিঝড় আঘাত হানতে যাচ্ছে। যার ক্ষয়-ক্ষতির মাত্রা নিরুপন উর্ধে। এসময় স্থানীয় প্রশাসনকে তাদের অভিজ্ঞতা ও নিজ নেতৃদ্ধে মানুষকে দূযোগ পূর্ববতী, দূর্যোগকালীন ও যোগাযোগ পুনঃরায় স্থাপন না হওযা পর্যন্ত দূর্যোগকালীন সকল প্রকার সহায়তা প্রদান ও উদ্ধার তৎপরতা চালাতে হবে।
আমি আশাকরি আমাদের জীবনে যেন কোন অবস্থাতেই ১১ নম্বর মহাবিপদ সংকে না আসে এবং আমরা সকলে যেন ঘূণিঝড়ের ভয়াবহতার হাত থেকে রক্ষাপাই। কিন্তু একটি বিষয় মনে রাখতে হবে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে আমরা বাংলাদেশের মানুষ আগের তুলনায় অনেক বেশী ঘূণিঝড়ে আক্রান্তের ঝূকিতে আছি এবং ঝুকি বাড়ছে। তাই প্রাণ, প্রাণীসম্পদ সহ গুরুত্বপূর্ণ সকল কিছু রক্ষায় আমাদের আরও বেশি সচেতন হতে হবে এবং অন্যদেরও সচেতন করতে হবে। গনমাধ্যমকর্মীদের এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রয়েছে আশাকরি তারা নিজেরা সতর্ক সংকেতের অর্থ পরিপূর্ণভাবে বোঝার চেষ্টা করবেন এবং সেই অনুযায়ী রিপোর্ট করে জনগনকে সহায়তা করবেন।
লেখকঃ আবু হেনা মোস্তফা জামাল পপলু, সংবাদকর্মী