প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রের পাশাপাশি হাতিয়েছেন দেশী-বিদেশী সহায়তার লাখ-লাখ টাকাও। সাথে ষোল কোটি মানুষের সহানুভূতি। বিস্ময়কর এই প্রতারণার অভিনেতা রাজবাড়ির গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার ইউনুস আলী ওরফে ইউসুফ। যে কিনা নিজের আখের গোছানোর মাধ্যম হিসেবে বেছে নিলেন বিশ্বের শত কোটি মানুষের বিবেক নাড়িয়ে দেয়া রানা প্লাজার ঘটনাকে।

গাছের মগ ডাল থেকে পড়ে আহত হলেন। আর পরিচয় দিলেন রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় আহত উদ্ধারকারি হিসেবে। বিনা পয়সায় চিকিৎসা নিলেন ঢাকা মেডিক্যাল, অ্যাপলোর পর সিআরপি থেকে। ২৪ এপ্রিল, ২০১৩। রানা প্লাজা ভবন ধস। দেশের ইতিহাসে সবচে মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনার সাথে জড়িয়ে আছে অনেক রক্ত, জীবন আর কষ্টের গল্প। ইউনুস আলী সরদার ওরফে ইউসুফ। রানা প্লাজার উদ্ধারকারী পরিচয়ে ১৭ মাস চিকিৎসাসেবা নেন পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র সাভারের সিআরপিতে। সবাই জানে এই ব্যক্তি স্বেচ্ছায়, উদ্ধারে নেমে প্রাণ বাঁচান অন্তত ১০ জনের। আর তা করতে গিয়ে বরণ করেন পঙ্গুত্ব। সে সময় দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম ইউসুফকে আখ্যা দেয় রানা প্লাজার বীর। বিজিএমইএতেও ইউসুফের নাম রয়েছে উদ্ধারকারির তালিকায়।

ইউসুফের পরিবার বলছে, ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর তরফে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের কাছ থেকে আরও ১০ লাখ এবং চিকিৎসায় বিজিএমইএর খরচ হয়েছে ৮ লাখ টাকা। এছাড়া, কয়েকটি বিদেশি এনজিও এবং ক্রেতা প্রতিষ্ঠানও ইউসুফকে দিয়েছে মোটা অংকের সহায়তা। তবে, গোপনীয়তার কারণে ব্যক্তি বিশেষের তথ্য জানাতে চায়নি তারা। এতো সাহায্য যাকে দেয়া হলো সেই ইউসুফ আসলেই কি রানা প্লাজা দুর্ঘটনার উদ্ধারকারী?

আর তা জানতেই যাত্রা শুরু ইউসুফের গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ি জেলার গোয়ালন্দ উপজেলায় নূরু মণ্ডলের পাড়ায়। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর ইউসুফ চার লাখ টাকা দিয়ে নতুন বাড়ি করেছেন। গড়ে তুলেছেন একটি গরুর খামারও। রেখেছেন বেতনভুক্ত একজন সেক্রেটারি। যার কাজ তার ব্যাংক ব্যালান্স ও সম্পদের দেখাশোনা করা।

স্থানীয়রা জানান, ইউসুফ ছিলেন ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার। পেশায় গাছ ব্যবসায়ী। রানা প্লাজায় কীভাবে আহত হয়েছিলেন, ইউসুফের কাছে সেই গল্প শুনতে চাইলে ভান করেন কথা বলতে না পারার। তাহলে… গল্পটা শোনা যাক তার স্ত্রীর কাছে। কিন্তু, অনুসন্ধান বলছে- যেদিন রানা প্লাজা ধস হয়, সেই একই তারিখে গোয়ালন্দর দেবগ্রাম ইউনিয়নের বেথুরি গ্রামে, একটি গাছ কাটতে গিয়ে মগ ডাল থেকে পড়ে গুরুতর আহত হন ইউসুফ। তাহলে দেখা যাক কোনটা সত্য, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি জানান, ইউসুফের গাছ থেকে পড়ার বিস্তারিত।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল গাছ থেকে পড়ে মাথায় জখম নিয়ে ইউনুস আলী ওরফে ইউসুফ প্রথম ভর্তি হন গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। এখানকার রেকর্ডে তার আঘাতের কারণ বলা হয়…গাছ থেকে পড়ে যাওয়া। একদিন পর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেয়া হয়। এবারের যাত্রা ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে। নথিপত্র পত্র ঘেটে দেখা যায়… ২০১৩ সালের ২৫ এপ্রিল থেকে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত এখানকার সার্জারি বিভাগে চিকিৎসা চলে ইউনুসের। এখানেও, তার আঘাতের কারণ বলা হয়েছে ‘ফল ফ্রম হাইট’ অর্থাৎ উচু থেকে পড়া।

ফরিদপুর থেকে ইউসুফ ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এখানকার রেকর্ড বিভাগের তথ্যে দেখা যায়, ইউসুফ রাজবাড়ির ঠিকানা গোপন করে লেখেন সাভার। মূলত, এখান থেকেই শুরু করেন নিজেকে রানা প্লাজা উদ্ধারকারী পরিচয় দেয়া।

ঢাকা মেডিকেলে তিন দিন থাকার পর বিজিএমইএর তত্ত্ববধানে ইউসুফকে ভর্তি করা হয় রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে। রেকর্ড বলছে- এখানে তার চিকিৎসা হয় টানা ২৫ দিন। ইউসুফের আইডি নম্বর ৪২১৪৭১। এরপর দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার জন্য ইউসুফকে নেয়া হয় সাভারের সিআরপিতে। আর এখানেও বিজিএমইএ-র তত্ত্বাবধানে তার চিকিৎসা চলে প্রায় ১৭ মাস।

বিজিএমইএ বলছে- পোশাক শিল্পে বিভিন্ন দুর্ঘটনায়, সব সময়ই এমন বেশ কিছু চক্র প্রতারণায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। ইউসুফ বিশ লাখ টাকা সহায়তা পাওয়ার কথা স্বীকার করলেও স্থানীয়রা জানান, তিনি দৌলতদিয়ায় আত্মীয়ের নামে ১৬ লাখ টাকা দিয়ে চার বিঘা জমি কিনেছেন এবং অগ্রণীসহ কয়েকটি ব্যাংকে তার রয়েছে বিপুল অর্থ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে