আসাদুজ্জামান সরদার, সাতক্ষীরা প্রতিনিধি: সীমান্ত নদী ইছামতীর বুকে ভাসে না দুই বাংলার মিলন মেলার তরী। ২০১২ সালে সর্বশেষ ভেসেছিল ওই উচ্ছ্বাসের তরী। তারপর থেকে আর নদীর বুকে ভাসতে দেখা যায়নি শারদ উৎসবের বিজয়া দশমীর মিলন মেলার তরী। ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় দুই বাংলার এ মিলনোৎসব। ২০১৭ সাল অব্দি ইছামতীর বুকে স্ব-স্ব দেশের জলসীমায় বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জন উপলক্ষে নৌ ভাসাতেন মানুষ। তারপর থেকে আর নৌ ভাসে না। অথচ হাজার বছর ধরে এপার-ওপার দুই বাংলার মানুষ এ উৎসবকে কেন্দ্র করে অপেক্ষা করতেন এক বছর থেকে আরেক বছরের জন্য।

হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। বিজয়া দশমীতে সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার সীমান্ত নদী ইছামতীতে প্রতিমা বিসর্জন উপলক্ষে মিলিত হতেন তারা। নদীর দুই তীর জুড়ে দেখা যেত হাজারো মানুষের উপচেপড়া ভীড়। এদিন নদীর তীরে নানা রকম পণ্যের পশরা সাজিয়ে বসতো ঐতিহ্যের মেলা। মিষ্টি-মিঠাই থেকে শুরু করে নানা পদের সামগ্রী থাকতো মেলায়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জমজম করতো নদীর দুই পাড়। সন্ধ্যায় আতশবাজির আলোয় রঙিন হয়ে উঠতো ইছামতীর দুঃখ-সুখের ঢেউ খেলানো জল। দিনভর চলতো শুভেচ্ছা বিনিময়। ওপারের নৌকা থেকে এপারের নৌকায় পাঠানো হতো নানা রমক মিষ্টি-মিঠাই আর উপহার সামগ্রী। অনুরূপভাবে এপারের নৌকা থেকে ওপারের নৌকায় পাঠানো হতো একই ধরনের উপঢৌকন। হাত নেড়ে অভিবাদন জানাতেন দু-দেশের মানুষ। বিদায় নেওয়ায় আগে বলতেন-সামনের বছর আবার দেখা হবে। এভাবে তাদের শেষ দেখা হয়েছিল ২০১২ সালে। তারপর আর সীমানায় যেতে-আসতে পারেননি কেউ।

বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতির অংশ হিসেবে দুই বাংলার এই মিলন মেলা আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারক হয়ে আছে। হাজার বছর ধরে এই মেলা হয়ে আসছিল। এ মেলাকে ঘিরে সৌহার্দ্য সম্প্রীতি আর ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে একাকার হয়ে যায় সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ। তারা পরস্পরকে শারদীয়া শুভেচ্ছা জানাতেন। ইছামতী নদীর টাউনশ্রীপুর ছিল সাতক্ষীরার প্রথম পৌরসভা। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ইছামতী নদীর পশ্চিম পাশে ভারতের টাকিতে চলে যায় সেই পৌরসভা। এরপর থেকে এলাকায় প্রায় ১০কিলোমিটার জুড়ে এই মেলা বসত। এতে অংশ নিতো দুই বাংলার মানুষ। ২০১২ সাল থেকে জঙ্গি হামলার আশঙ্কায় এই মিলনমেলা স্তিমিত হয়ে যায়। এরপর নদীতে নৌকা ডুবে কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রসহ দু’জনের সলিল সমাধি ঘটে।

সাতক্ষীরার এপারে দেবহাটা উপজেলার টাউন শ্রীপুরের জমিদার বাড়ি ওপারে ভারতের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার বশিরহাট মহকুমার হাসনাবাদ থানার টাকী জমিদারবাড়ি। দেড় কিলোমিটারের বেশি চওড়া ইছামতীর মধ্যসীমা বরাবর বিজিবি ও বিএসএফ এর নজরদারির মধ্যে চলতো নদী তীরে আসা প্রতিমা বিসর্জন। তবে প্রায় এক যুগ ধরে চলেনি এপার বাংলা ও ওপার বাংলার মানুষের মধ্যে মিষ্টি বিনিময়, চলেনি উপহার বিনিময়। হয়নি উভয় দেশের মানুষের মিলন মেলা। এছাড়াও করোনাকালীন বিধি নিষেধের কারণেও কয়েক বছর ধরে স্ব-স্ব দেশের সীমানায় এই মিলনমেলা প্রাণহীন হয়ে পড়ে।

দেবহাটা উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি মীর খায়রুল আলম জানাচ্ছিলেন—সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সর্ব বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। প্রতি বছর ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পূজার সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয় বিজয়া দশমীতে। এই দিনটিতে আর্ন্তজাতিক সীমানার বয়ে চলা ইছামতি নদীতে একসঙ্গে প্রতিমা বিসর্জন করেন বাংলাদেশ- ভারতের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। বিগত বছরগুলোতে প্রতিমা বিসর্জনকে ঘিরে ইছামতির দুপাড়ে বাংলাদেশ ও ভারতের লাখো মানুষের উপস্থিতিতে বসতো শত বছরের ঐতিহ্যবাহী মিলন মেলা। বছরে এই একটি দিনে সীমানার গণ্ডি এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ ভুলে সৌহার্দ ও সম্প্রীতির মেলবন্ধনে একসঙ্গে আনন্দ উৎসবে মেতে উঠত দুদেশের লাখো মানুষ। ইছামতি নদীর বুক চিরে ভাসতো বাংলাদেশ ও ভারতের হাজারও নৌকা, ট্রলার, লঞ্চ। পাসপোর্ট ভিসা ছাড়াই এই দিনটিতে কয়েক ঘণ্টার জন্য ভারতের মানুষ বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশের মানুষ ভারতে প্রবেশ করার সুযোগ ছিল। বেড়ানো, কেনাকাটা এবং ভিন্ন দেশে থাকা আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে দেখা করে সন্ধ্যার আগেই সবাই আবার ফিরে যেত যার যার দেশে। প্রতি বছর দুর্গাপূজা আসলেই কাঙ্ক্ষিত সেই মিলনমেলার অপেক্ষা করতে থাকে দু’দেশের মানুষ। বিগত কয়েক বছর যাবত আইন-শৃঙ্খলা সমুন্নত রাখতে এবং উভয় দেশের মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে পারাপারসহ সন্ত্রাসী, পলাতক আসামী, দুষ্কৃতিকারীরা যাতে করে অবৈধভাবে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে না পারে সেজন্য কঠোর এই ব্যবস্থা নিয়েছে প্রশাসন। দু’দেশের জাতীয় ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কঠিন সিদ্ধান্তে ঐতিহ্যবাহী এই মিলন মেলা স্ব-স্ব জলসীমানায় অনুষ্ঠিত হলেও কেউই কোনো দেশের স্থলে উঠতে পারেননি। অসুর শক্তিকে বিনাশ করে শান্তির বরাভয় আর শস্যশ্যামলা বসুন্ধরা উপহার দিয়ে মর্ত্যভূমির পিত্রালয় থেকে দোলায় চড়ে কৈলাসে ফিরে গেলেন দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা।

সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ‘মা তুমি আবার এসো’ উচ্চারণে ঝরালেন বিষাদে আনন্দাশ্রু। তবে দর্শক এবং এলাকাবাসীর দাবি, এই মিলনমেলার পুনরুজ্জীবনের। এর মধ্য দিয়ে তারা বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক উন্নয়নে অসাম্প্রদায়িকতার বার্তা ছড়িয়ে দিতে চান। দেবহাটা উপজেলার বাসিন্দা গোপাল কুমার দাশ স্মৃতিচারণ করে জানান, বিজয়া দশমীর দিনে ছোটবেলা বিকেল হলেই ছুটে যেতাম ইছামতীর পাড়ে। নদীর পাড়ে বসতো মিলন মেলা। কিন্তু সেটি বন্ধ হওয়ায় আমরা মিলন মেলার আনন্দ আর উপভোগ করতে পারছি না। যদি প্রশাসনিকভাবে মেলাটি চালু করা যায় তাহলে বাঙালির এই গৌরবময় ঐতিহ্য টিকে থাকবে। তা না হলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এই উৎসবটির কথা ভুলে যাবে।

উপজেলা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি চন্দ্র কান্ত মল্লিক জানান, দেবহাটা উপজেলার প্রতিটি মণ্ডপে নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে দুর্গাপূজা সম্পন্ন হয়েছে। বিগত দিনগুলোতে দেবহাটা উপজেলায় কোন বিশৃঙ্খলা বা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এবারও আমরা ভালোভাবে এই উৎসব শেষ করতে পেরেছি। প্রশাসন আমাদের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ করেছেন। আমরা সবার সহযোগিতা পেয়েছি। তিনি আরও জানান, বিজয় দশমীর দিন ঘিরে ইছামতি নদীতে যে মিলন মেলা হতো তা দেশ বিভাগের আগে থেকে চলে আসছে। কয়েক বছর সেটি বন্ধ হওয়ায় মিলন মেলার কথা আমরা ভুলতে বসেছি।

দেবহাটা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ আসাদুজ্জামান জানান, ইছামতি নদীতে যে মিলন মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিল তা কয়েক বছর বন্ধ রয়েছে। এ বছরও মিলন মেলা হয়নি। উভয় দেশের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে